অনেক বেশি বাঙালি

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। শিক্ষাবিদ, বহুভাষাবিদ, জ্ঞানতাপস, ধর্মাচারী। এসবের বাইরে এই মনীষীর আরেকটি বড় পরিচয়—তিনি বাঙালি। আজ তাঁর ৫০তম মৃত্যুদিন। এ উপলক্ষে তাঁর ছেলে বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর উন্মোচন করেছেন পিতার অজানা অধ্যায়।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ (১০ জুলাই ১৮৮৫–১৩ জুলাই ১৯৬৯) ড্রইং: মুর্তজা বশীর, ১৯৫৩
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ (১০ জুলাই ১৮৮৫–১৩ জুলাই ১৯৬৯) ড্রইং: মুর্তজা বশীর, ১৯৫৩

বাবা ও আমি
আমার আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার পেছনে, এটা সত্যি যে, আমার বাবা মুহম্মদশহীদুল্লাহ্‌র আগ্রহ বা অনাগ্রহ কোনোটাই ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ওখানে ভর্তি হই আমি। আমার নিজেরও তেমনভাবে ছবি আঁকার ইচ্ছে ছিল না; ছোটবেলা থেকে আমি ছবি আঁকতামও না। স্কুলজীবনে শ্রেণিকক্ষে যে ড্রয়িং হতো, সে ড্রয়িংয়ে প্রায় সময়ই আমি শূন্য পেতাম।

কমিউনিস্ট পার্টি আমাকে বলল, আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে হবে, এখানে পার্টিকে সংগঠিত করতে হবে। সে সময় ছাত্র–শিল্পীদের দেখে মনে হতো তারা ভিন্ন জগতের মানুষ। বড় বড় চুল, আধো আধো কথা, পরিষ্কার কথা নয়, কেমন জানি একটা ভাব নিয়ে থাকত। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা—এগুলো প্রচার করার জন্য আমাকে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে হয়।

১৯৩৯ সালে ছোটবেলায় ঢাকায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কাউট হয়েছিলাম। আমি ছিলাম বয়েজ স্কাউট। আমার স্বপ্ন ছিল কিং স্কাউট হব। তখন কিং স্কাউটের ব্যাজটা ছিল এমব্রয়ডারি করা রাজার মুকুট। তখন তো ব্রিটিশ আমল। স্কাউটদের শপথ নিতে হতো ইংল্যান্ডের জাতীয় পতাকা ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ নিয়ে। আমি যখন কিং স্কাউটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, সে সময় ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়ে গেল। পাকিস্তানে কিং স্কাউটের নাম পাল্টে হলো ‘কায়েদে আজম স্কাউট’। তখন আমি রাজনীতিতে ঢুকেছি, কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য। আমরা বলছি, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, সাচ্চা আজাদি লেনা হ্যায়’, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।’ যেহেতু পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে আমাকে শপথ নিতে হবে, তাই আমার ছোটবেলার যে স্বপ্ন, সেই কিং স্কাউট হওয়ার জন্য আমি পরীক্ষাই দিলাম না।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বাবাকে প্রথম যখন আমার আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা বলি, তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। বলেছিলেন, ‘আমি প্যারিসে ছিলাম, সেখানে আর্টিস্টদের দেখেছি খুব অভাব, অনটনে থাকে। তুমি আমার ছেলে, তুমি অভাব-অনটনে পড়ো, এটা আমি চাই না। অতএব, তুমি আলিগড়ে যাও, বিএ পাস করো, তারপর তুমি ছবি আঁকো।’ কিন্তু যখন তিনি দেখলেন, আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য আমি খুব অটল এবং ঢাকাতেই পড়তে চাচ্ছি আমি, তখন বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে পড়ো।’ তিনি রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা শেষে তাঁকে কার্যনির্বাহী পর্ষদের সদস্য নিযুক্ত করে পত্র লিখেছিলেন। তবে আমার তো উদ্দেশ্য আর্ট পড়া নয়। আমার উদ্দেশ্য হলো এখানে থেকে আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় কর্মী হিসেবে যুক্ত থাকা। একই সঙ্গে ময়মনসিংহের সুসং দুর্গাপুরের হাজং অধ্যুষিত এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সংঘটিত জনযুদ্ধে শরিক হওয়া। সেই সময় পশ্চিবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপে ও অন্ধপ্রদেশের তেলেঙ্গানাতে মুক্তির লড়াই শুরু হয়েছে। কিন্তু আমার ভাই কমিউনিস্ট নেতা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ভ্রাতৃস্নেহ হেতু চাননি, তাই সেই লড়াইয়ে যুক্ত হতে পারিনি।

তো, ঢাকায়, আর্ট স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে আমি যখন খুব নাছোড়বান্দা, বাবা মানে বাবু (আমি তাঁকে বাবু বলে ডাকতাম) আমার সঙ্গে কথা বললেন না দুদিন। আমার বয়স তখন সতেরো। এরপর তিনি যেটা করলেন, তাতে আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। প্যারিস থেকে তিনি যখন ১৯২৮ সালে ফিরে আসেন, তখন ভারতীয় ছাত্র অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে দুই খণ্ড ল্যুভর মিউজিয়ামের ছবির রঙিন রিপ্রোডাকশনের অ্যালবাম উপহার দিয়েছিল। তিনি যদি শিল্পপ্রেমী না হন, তাহলে তারা তাঁকে ওটা কেন দেবে! তাঁকে কলম দিতে পারত। চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা করতে গেছেন, সে সম্পর্কে বই দিতে পারত। তারা তো তা দেয়নি। এই অ্যালবামটা তাঁর অন্য মূল্যবান বইপত্রের সঙ্গে ছোট্ট মেহগনি কাঠের আলমারিতে তালা মারা থাকত। একদিন আমার হাতে অ্যালবামটা তুলে দিয়ে তিনি আমাকে বললেন, এত দিন আমার কাছে ছিল, আজ থেকে তোমার। যেখানে অনেক নগ্ন নারীর ছবি আছে, তাঁর অন্যান্য ছেলে, যারা যৌবনপ্রাপ্ত বা বিবাহিত, তাদের কিন্তু তিনি এটা দেননি। কারণ হলো, তিনি এটুকু বুঝেছিলেন, ডিফারেন্স বিটুইন ন্যুড অ্যান্ড ন্যাকেড বা ন্যুড ও ন্যাকেডের ভেতরের পার্থক্য। এতে বোঝা যায়, শিল্পকলার প্রতি শহীদুল্লাহ্‌র একটা ভালোবাসা ছিল।

দ্বিতীয় হলো ইতালিতে আমি কিন্তু বৃত্তি নিয়ে পড়িনি। যখন আমি ইতালি যাই, বাবা আমাকে রেনেসাঁসের পীঠস্থান ফ্লোরেন্সে অ্যাকাডেমিয়া দি বেল্লেআর্তিতে পড়ার পয়সা দিয়েছেন। আমি উনিশ শ ছাপ্পান্ন থেকে আটান্ন সাল পর্যন্ত ফ্লোরেন্সে ছিলাম। ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘নাইন পাকিস্তানি আর্টিস্ট’ শিরোনামে একটা প্রদর্শনী হয়েছিল। এই প্রদর্শনীর একজন অংশগ্রহণকারী ছিলাম আমি। পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকায় যাদের যাদের ছবি প্রশংসিত হয়েছে, সেখানে আমার নাম ছিল। কিন্তু আমার নাম ভুলভাবে মুদ্রিত হয়েছিল। ওখানে আমার নাম লেখা হয়েছিল মুর্তজা রশীদ। এতে বাবা অবজার্ভার পত্রিকার লেটার টু এডিটর–এ রিজয়েন্ডার দেন। সেখানে তিনি লেখেন যে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন তাঁর ছেলের ছবি প্রশংসিত হয়েছে, এই জেনে। তবে তার নাম এখানে মুদ্রণবিভ্রাট হয়েছে। তার নাম মুর্তজা রশীদ নয়, মুর্তজা বশীর। তবে তার আসল নাম এ কে এম বশীরুল্লাহ্‌, অর্থাৎ আবুল খয়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ্‌। আবুল খয়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ্‌—এই নামটা ব্যবহার করার জন্য তিনি আমাকে বারবার অনুপ্রাণিত করতেন, কিন্তু এই নামটাকে আমি বাদ দিয়েছিলাম। কারণ, আমি দেখেছিলাম, আমি সমাজে যা কিছুই অন্যায় করি না কেন, শহীদুল্লাহ্‌র ছেলে বলে আমাকে কেউ কিছু বলে না।

১৯৪৯ সাল। বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে ঢাকায় চলে এসেছি আমরা। একদিন বাবার লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এমন সময় ডাকপিয়ন অনেকগুলো চিঠি দিয়ে গেল। আমার বাবা ওগুলো দেখে একটা চিঠি ফেরত দিয়ে বললেন, এই নামে এখানে কেউ থাকে না। তখনই আমি বললাম, দেখি। তারপর দেখে বললাম, এটা আমার চিঠি। বাবু অবাক হয়ে গেলেন, তোমার চিঠি! তুমি মূর্তজা বশীর কবে থেকে হলে! আমি বললাম, আমি আপনার নামে পরিচিত হতে চাই না। আমি আমার নামে পরিচিত হতে চাই। তিনি শুনলেন। চুপ করে থাকলেন। তখন পর্যন্ত আমার নামের বানান ম দীর্ঘ-ঊ কার লিখতাম—মূর্তজা। তিনি তখন বললেন, দেখো, মূর্খের বানান হয় ম দীর্ঘ-ঊ কার। কিন্তু তুমি তো বুদ্ধিমান। তুমি ম হ্রস-উ কার লিখবে—মুর্তজা। তারপর থেকে ম হ্রস-উ কার লিখি। পরবর্তীকালে যখন ১৯৬০ সালে লাহোর থেকে করাচিতে গিয়েছি, বাবা তখন করাচিতে উর্দু ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের প্রধান সম্পাদক। আমি তাঁকে বলেছি, আমার জন্য রং নিয়ে আসবেন। তিনি আমার জন্য রং নিয়ে এসেছেন। ১৯৫০–এ যখন দেশের বাড়ি চব্বিশ পরগনায় গিয়েছেন, তাঁকে চিঠি লিখেছি, আসার সময় কলকাতার চৌরঙ্গিতে জে সি লাহার দোকান থেকে আমার জন্য রং নিয়ে আসবেন। তিনি এনেছেন।

১৯৫৯–তে যখন করাচিতে আমার ছবির প্রদর্শনী করছি, আমার বাবা—বাবু—সেই প্রদর্শনীতে এসেছেন। সেই সময় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন বগুড়ার হাবিবুর রহমান। প্রদর্শনীটা তিনি উদ্বোধন করেছিলেন। আমেরিকার একটা সংগঠন ‘অ্যামেরিকান ফ্রেন্ড অব দ্য মিডিলইস্ট’। এর পরিচালক ছিলেন স্ট্যানলি ওয়াটসন সাহেব। তিনিও আসতেন প্রদর্শনীতে। তো, সেখানে ককটেল, মদ—এগুলাও পরিবেশন করা হতো। এসবের মধ্যেই বাবু এলেন। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, শহীদুল্লাহ্‌ প্রদর্শনীতে ঢুকলেন। চারদিকের পেইন্টিংয়ে নারীমূর্তিসহ নানা ছবি। এর মধ্যে একটি স্টিললাইফ ছবি, যেখানে কোনো নারী কিংবা জীবজন্তুর ছবি নেই, এমন এক জায়গায় দাঁড়ালেন তিনি। পাঞ্জাবির পকেট থেকে কাপড়ের জায়নামাজটা বিছিয়ে মাগরিবের নামাজও পড়লেন। এদিকে আমার ততক্ষণে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে গেছে, লোকে ভাববে যে আমি একটা গোঁড়া মুসলমানের ছেলে! আমি তো আধুনিক, ইতালি থেকে সদ্য ফেরত। তিনি যদি ধর্মান্ধ হবেন, তাহলে আমার প্রদর্শনীতে গেলেন কেন!

১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমিতে সমকালীন চিত্রকলার এক প্রদর্শনীতে ‘ডেড লিজার্ড’ (মৃত টিকটিকি) শিরোনামে একটা ছবি ছিল আমার। বাসায় এসে সোজা আমার ঘরে ঢুকে বাবা বললেন, ‘তোমার সেই ছবিটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।’ তাঁর কথায় আমার ভেতরটা নড়ে ওঠে। তিনি দরজায় নক না করে কখনো ঘরে ঢুকতেন না। কিন্তু তাঁর এই ব্যতিক্রম দেখে বিস্মিত হই এবং আমার ছবি সম্পর্কে যে কথাটা তিনি বললেন, আমার জন্য তা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান। আমাকে তিনি বললেন, তুমি আর্টিস্ট, সুন্দর জিনিস আঁকবে। প্যারিসে ল্যুভর মিউজিয়ামে দেখেছি শিল্পকলা কত চমৎকার। সেগুলো সুন্দর। আমার এই প্রদর্শনী উপলক্ষে এক ঘরোয়া আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছিল। বিষয় ছিল ‘আধুনিক চিত্র ও আধুনিক শিল্পী’। পাকিস্তানের আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবী এ কে ব্রোহি ছিলেন প্রধান বক্তা। শহীদুল্লাহ্‌কে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ডক্টর সাহেব, আপনার ছেলে তো একজন আধুনিক শিল্পী। জবাবে তিনি হেসে বলেছিলেন, আধুনিক চিত্রের মতোই আমার ছেলে আমার কাছে দুর্বোধ্য।

১৯৬৮ সালে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের (তদানীন্তন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান) মূল ব্যাংকিং হলে ‘টাকার ক্রমবিকাশ’ শিরোনামে ৭ ফুট বাই ১০০ ফুট ম্যুরাল চিত্র রচনাকালে যখন হাসপাতালে বাবুকে দেখতে যেতাম, আমার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইতেন তিনি। সে বছরের জুলাই মাসে আমার মা মরগুবা খাতুন মারা যান। তখন আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম, কাজ করতে মন চাইত না। সে সময় সাহস জুগিয়েছেন বাবু। বলেছেন, কাজ করে যেতে হবে তোমাকে। তাঁর এই কথা শুনে পূর্ণোদ্যমে আবার ছবি আঁকা শুরু করি। ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এই ম্যুরাল চিত্রটা উদ্বোধন করেন।

বাবু আমার জন্য রংটং এনে দেন কেন? আবার পত্রিকায় যদি আমার কথা বেরোয়, তিনি কেন এটা পড়েন? ১৯৬৯ সালে বাবু যখন মৃত্যুশয্যায়, সুফি দর্শনের লেখক ড. এনামুল হককে বললেন, এনাকে চেনেন? মুর্তজা বশীর। হি ইজ আ ফেমাস আর্টিস্ট। আমাকে চিঠিপত্রও লিখেছেন, মুর্তজা বশীর আর্টিস্ট নামে। এই হলেন আমার বাবু। আমার সম্পর্কে, আমার ছবি সম্পর্কে তাঁর মমতা ছিল এমনই।

কিছু ভ্রান্তি বিষয়ে
পবিত্র সরকার শহীদুল্লাহ্‌ প্রসঙ্গে এক আলোচনায় আমার ছবি আঁকার ঘটনাকে ইঙ্গিত দিয়ে দেখিয়েছেন যে যেহেতু তিনি ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন, তাই আমার ছবি আঁকাকে সমর্থন করতে পারেননি। আমার সঙ্গে ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে তাঁর দেখা হলে এই প্রসঙ্গের সূত্র এবং উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত সুনন্দন কুমার সেন রচিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ জীবনী গ্রন্থেও এই ভুল ধারণারই প্রতিধ্বনি দেখতে পাই। সেখানে উল্লেখিত হয়েছে তাঁর ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য আমাকে চিত্রশিল্পচর্চায় সম্মতি দিতে পারেননি। তাঁর ধর্মবিশ্বাসকে একধরনের অনড় প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতারূপে চিত্রিত করা হয়েছে, যা শহীদুল্লাহ্‌-চরিত্রে কালিমা লেপন ছাড়া আর কিছু নয়।

তাঁর দুটি বই বিদ্যাপতি শতক পদ্মাবতীর প্রচ্ছদ করেছিলাম আমি। ১৯৫৪ সালে তিনি বিদ্যাপতি শতক গ্রন্থটির প্রচ্ছদের কথা বললে আমি তাঁর কাছে জানতে চাই, প্রচ্ছদের জন্য কত দেবেন? শুনে বিস্মিত হন তিনি। বলেন যে, তোমাকে আমি আর্ট পড়ালাম। উত্তরে আমি বলেছিলাম, এটা পিতার কর্তব্য। আপনি সাধারণত প্রচ্ছদের জন্য যা দেন, তার অর্ধেক দেবেন। বাবু কোনো কথা না বলে মানিব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।

১৯৬৬ সালে ঢাকা জাদুঘরের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাকিস্তান জাদুঘর সমিতির সভাপতি মমতাজ হাসানসহ শহীদুল্লাহ্‌কে হিন্দু-বৌদ্ধযুগের ভাস্কর্যের নিদর্শন পর্যবেক্ষণের ছবি দেখতে দেখা যায় (মাহে নও, ১৮ বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা)। তা ছাড়া মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বাবু একজন পেশাদার মডেলের মতো বসে তাঁর ছবি আঁকতে বলেছিলেন আমাকে। তাঁর ছবি এর আগেও এঁকেছি, তবে দূর থেকে তাঁকে না জানিয়ে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে শহীদুল্লাহ্‌র অসাম্প্রদায়িক মনোভাবই ফুটে ওঠে।

প্রচলিত কাহিনি এবং ভ্রান্তির অবসান
শহীদুল্লাহ্‌ সম্পর্কে খুবই প্রচলিত কাহিনি যে গানবাজনার সময় তিনি কানে দুই আঙুল দিয়ে রাখতেন এবং নাচ চলার সময় হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখতেন। কিন্তু তাঁর এ-সংক্রান্ত ভিন্ন তথ্যও দেখা যায়। আমার বড় বোন মাহযূযা হকের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল হকের স্ত্রী) লেখার মাধ্যমে গানবাজনা সম্পর্কে পিতার যে বিষয়টা আমি জেনেছি, ১৯৩০ সালে দেশের বাড়ি পেয়ারা গ্রামে আমার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্দরমহলে মাগরিবের নামাজের সময় গ্রামোফোন বাজানোতে রাগান্বিত হয়ে গ্রামোফোনটা শূন্যে তুলে ভেঙে ফেলেন বাবা। বলেছিলেন, ‘এটা কি বেদীনের বাড়ি?’ তাহলে দেখা যায়, তিনি নামাজের সময় গ্রামোফোন বাজানোর জন্য ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। অন্যথায় নয়।

প্যারিস থেকে ফেরার সময় এই গ্রামোফোন তিনি কিনেছিলেন। আবার ঢাকার জগন্নাথ হলের প্রাক্তন ছাত্র সুকুমার রায়ের এক লেখায় পড়েছি (বাসন্তিকা, হীরকজয়ন্তী সংখ্যা), সে একটু গানবাজনা করত, শহীদুল্লাহ্‌ তাকে ধরে প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরির মালিক আবদুর রশীদ সাহেবের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি‌ তাঁর বগলদাবা থেকে নিজের অনূদিত হাফিজের লেখা গান বের করে বললেন, তুমি এটার সুর করো। সে ইতস্তত করছিল দেখে শহীদুল্লাহ্‌ জানতে চান, কী সমস্যা। সুকুমার রায় তবলার কথা বলাতে তিনি তবলা জোগাড় করেন।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের এক লেখায় দেখা যায়, শহীদুল্লাহ্‌ ঢাকার রূপলাল হাউসের মালিককে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর অনূদিত হাফিজের কবিতায় কীর্তনের সুর তুলে দিতে। (এক্ষণ, তৃতীয় বর্ষ, ১ জানুয়ারি ১৯৮৬)।

অন্যদিকে বাংলা একাডেমির পত্রিকায় দেখা যায়, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস, জিন্নাহর জন্মবার্ষিকী ও একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আহুত সভা, কবিতা পাঠের আসর এবং দেশাত্মবোধক সংগীতানুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শহীদুল্লাহ্‌।

ডেইলি স্টার পত্রিকায় একটি ছবি দেখেছি যেখানে পিয়ানোয় সুর তোলা অবস্থায় সুরকার আবদুল আহাদ স্মিত হাসি দিয়ে পাশে বসা শহীদুল্লাহ্‌র দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার বড় বোন মাহযূযা হক বলেন, ‘একবার গিরিশচন্দ্রের প্রফুল্ল নাটক রাতভর দেখেছি। মা স্যার এ এফ রহমানের বিবি লেডি রহমানের সঙ্গে কার্জন হলে এক নাটকে গিয়েছিলেন। ঢাকায় প্রথম নির্বাক সিনেমা দুর্গেশনন্দিনী এলে আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, যা সফীকে নিয়ে আরমানিটোলায় পিকচার হাউসে সিনেমা দেখে আয়। (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌: পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন )।

আমি জীবনে প্রথম সিনেমা দেখেছি বাবার সঙ্গে। তখন আমি স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ি। আমাকে ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে সুইজ ফ্যামিলি রবিনক্রুজ দেখান তিনি। সিনেমা হলটি ছিল পল্টনের খোলা ময়দানে—বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ—সেখানে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ও মার্কিন সৈনিকেরা ওখানে ইংরেজি সিনেমা দেখতে আসত। ছবি দেখে যখন ঘোড়ার গাড়িতে ফিরছি, হঠাৎ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, শিস বাজাতে পারো? আমি শিস বাজাতে জানতাম না। তিনি মৃদুভাবে শিস বাজালেন। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও যখন আমি শিস বাজাতে পারছিলাম না, তখন আমাকে তিনি শেখালেন কীভাবে শিস বাজাতে হয়। অবশেষে আমি পারলাম। যখন পারলাম, দেখি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর চোখমুখ। তারপরই আমাকে বাবু বললেন, যখন-তখন শিস বাজিয়ো না, এটা খুব খারাপ। ততক্ষণে নতুন আবিষ্কারে আমার মনে জেগেছে আনন্দের বান, কিন্তু বাবার দিকে তাকিয়ে শিস বাজানো ভুলে গেলাম। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল।

প্যারিসে প্রাচ্য-প্রতীচ্য ছাত্র সম্মেলনে উদয়শঙ্করের একটি নাচের অনুষ্ঠান শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মিলিতভাবে ভারতবাসীর পক্ষে আয়োজন করেছিলেন শহীদুল্লাহ্‌। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে কলকাতা থেকে বিশিষ্ট সাহিত্যিকবৃন্দ প্রাবন্ধিক কাজী আবদুল ওদুদ, কবি নরেন্দ্র দেব ও তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী রাধারানী দেবী, সাহিত্যিক মনোজ বসু, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও লেখক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় যোগ দেন। আমি শহীদুল্লাহ্‌র পুত্র শুনে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় শহীদুল্লাহ্‌র জীবনের একটি ঘটনা জানান আমাকে। ঘটনাটি এমন: কোনো এক ঘরোয়া আসরে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ এক পাশে নিশ্চুপ বসে আছেন। মুখে পান চিবুতে চিবুতে কাজী নজরুল ইসলাম হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছেন আর টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে নাচছেন শহীদুল্লাহ্‌। আমার বড় বোনের লেখায় জেনেছি, শালিমহলে বাবার নাচের সুখ্যাতি ছিল।

শহীদুল্লাহ্‌র জীবনের প্রথম লেখা ‘মদনভস্ম’ ২৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের বোনের পত্রিকা ভারতীতে (৩৩শ বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৯১৬ সালে) প্রকাশিত হয়। শহীদুল্লাহ্‌ রক্ষণশীল পরিবারে ইসলামি আবহ ও পরিবেশেই মানুষ হয়ে তাঁর পরিচিত জগৎ মহরম বা কারবালা, শবে কদর কিংবা শবে মিরাজ এবং মহানবী (সা.) ও খলিফাদের ওপর না লিখে লিখলেন হিন্দুধর্মভিত্তিক রচনা। সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবী লেখেন, ‘নিম্নলিখিত ক্ষুদ্র প্রবন্ধটি একজন মুসলমানের লেখা। আজকাল বাঙলা সাহিত্যকে জাতীয় সাহিত্যরূপে গ্রহণের দিকে আমাদের মুসলমান ভ্রাতৃগণের মধ্যেও একটি চেষ্টা দেখা যাইতেছে। ইহা বড়ই সুখের বিষয়।’

শহীদুল্লাহ্‌ তখন ছাত্র। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এক সভায় তাঁর অবর্তমানে ‘হেমচন্দ্রের দেশী নাম-মালা’ শিরোনামে শহীদুল্লাহ্‌ লিখিত এক প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। সেই সাহিত্যসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। শ্রী শ্যামলাল গোস্বামী আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভবিষ্যতে প্রবন্ধের যাতে নিয়ম সংগত হয়, কোনো চর্বিত-চর্বণ প্রবন্ধ পাঠ না হওয়া উচিত।’ সে সময় সভাপতির ভাষণে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, ‘...লেখক একজন মুসলমান। এই সকল ভাষাতত্ত্বের আলোচনা তাঁহার পক্ষে শ্লাঘার বিষয়। আমরা তাঁহার উদ্যোমে আনন্দিত। তাঁহাকে উৎসাহিত করা উচিত।’ (সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ২৬ বর্ষ)।

কিন্তু, প্রথমত তিনি তো বাঙালি, তারপর ধর্মীয় বিচারে মুসলমান। আশ্চর্য হলো তাঁর বাঙালি সত্তাকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে মুছে ফেলা হচ্ছে। তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, মিলাদ, ওয়াজ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রগতিশীল নামধারীদের কাছে নিন্দিত হয়েছেন। শহীদুল্লাহ্‌ ধর্মপ্রাণ হলেও ছিলেন মুক্তবুদ্ধির মানুষ। ধর্মপ্রচারের বাড়াবাড়ি তিনি পছন্দ করতেন না। প্যারিস থেকে ফরিদপুর খাদেমুল এনসান সমিতির মুখপাত্র মাসিক মোয়াজ্জিন পত্রিকার সম্পাদককে তিনি লেখেন, ‘...অনেক দিন পরে এমন ধুম পাড়িয়া গিয়াছে ধর্ম প্রচারের।...ইসলাম প্রচার করিতে হইলে মানুষকে দুনিয়াতে বেহেস্তের আস্বাদ দেওয়াইতে হইবে। চারিদিকে ক্ষুধার্তের হাহাকার, পীড়িতের চিৎকার। দরিদ্রের ক্রন্দন ও উৎপীড়িতের আর্তনাদ। এখানেই হাভিয়া দোযখ। যে এই দোযখ নিভাইতে পারে সে-ই প্রকৃত ইসলাম প্রচারক।...’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স যখন সত্তর বছর হলো, প্রবাসী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁর জন্মোৎসব উদ্‌যাপনের বিবরণ: রবীন্দ্রনাথ তপস্বীর মতো বসে আছেন। বৈদিক মন্ত্র পড়া হচ্ছে। ধূপ, দীপ, শঙ্খ, দূর্বাদল, চন্দন দিয়ে অর্ঘ্য দেওয়া হচ্ছে। অতঃপর এই অর্ঘ্যসম্ভারপূর্ণ থালাগুলো কয়েকজন বালিকা কবির কাছে নিয়ে গেলে স্মিত হাসিযোগে হাত দিয়ে তিনি সেগুলো স্পর্শ করছেন।

হিন্দু–মুসলমান বৈষম্য
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ মুসলমান বলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সংস্কৃত নিয়ে এমএ পড়তে পারেননি তিনি। মুসলমান বলে রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক পদে আসীন হতে পারেননি। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন এক চিঠিতে শহীদুল্লাহ্‌কে লিখেছেন, শহীদুল্লাহ্‌ মুসলমান বলে তাঁর চাকরি হয়নি। একই কথার পুনরাবৃত্তি করে শ্রী সুকুমার সেন তাঁর এক জন্মবার্ষিকীর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘...দুজন যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন: ডক্টর শহীদুল্লাহ্‌ আর ডক্টর সুশীল কুমার দে।...শহীদুল্লাহ্‌ মুসলমান বলে তাঁকে মনোনীত না করলেও সুশীল দে-কে এড়ানো শক্ত। তাই রবীন্দ্রনাথকে অস্থায়ী বিশেষ অধ্যাপক করা হল...’ (গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, ধ্রুপদী ব্যক্তিত্ব: সুকুমার সেন, কথা সাহিত্য, নবম-দশম যুগ্ম সংখ্যা, আষাঢ়-শ্রাবণ, ১৩৮৯)। এই বিভেদ ও বৈষম্য দূর করার জন্য শহীদুল্লাহ্‌ চেয়েছিলেন বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সরকারি ও বেসরকারি কোনো জায়গায় ধর্মীয় শ্রেণি বা গোত্র লিখতে পারবে না। তবে পারিবারিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় নাম ব্যবহার করা যেতে পারে। তাঁর এই প্রস্তাব পড়ে কাজী আবদুল ওদুদ মন্তব্য করেছিলেন, তাহলে শহীদুল্লাহ্‌ নাম হওয়া উচিত আচর্য বলিনারায়ণ।

শহীদুল্লাহ্‌ বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমকক্ষ হতে হলে তিনি ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম মুসলমান ছাত্র সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘কিন্তু কবে সেদিন হইবে, যেদিন আমাদের শিক্ষিত যুবকগণ আইন কলেজের ন্যায় মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, এগ্রিকালচারাল কলেজ, আর্ট স্কুল, কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট, মাইনিং ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল স্কুল, ট্রেনিং কলেজ, ট্রেনিং স্কুলে দলে দলে ভর্তি হইবে?’ কেননা, তিনি মনে করতেন, ‘সমাজের জন্য ব্যারিস্টার, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক, গ্রন্থগারিক, চিত্রকর, ইঞ্জিনিয়ার, ওভারসিয়ার, কৃষি, শিল্পী, বণিক সকলেরই প্রয়োজন।’ তাই তিনি গ্রামেগঞ্জে নৌকায় ও পালকিতে চড়ে শিক্ষার প্রয়োজনীতার ওপর একজন ক্রিশ্চিয়ান মিশনারির মতো চষে বেড়িয়েছেন। শহীদুল্লাহ্‌র ‘...দৃঢ় বিশ্বাস যে পর্য্যন্ত হিঁন্দু– মুসলমান শিক্ষায় মাথায়–মাথায় না হবে, সে পর্য্যন্ত হিন্দু–মুসলমান সমস্যার সমাধান হবে না, সেই পর্য্যন্ত দেশের স্থায়ী কল্যাণ হবে না।’ তাই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ১৯২৬ সালে প্রকাশিত অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ (ওডিবিএল)ম্যাগনাম ওপুস-এর মতো গ্রন্থ রচনা করতে পারেননি ঠিকই, তবে সুনীতিবাবুর গ্রন্থের বহু আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল অব দ্য ডিপার্টমেন্ট অব লেটার্স-এ ১৯২০ সালে শহীদুল্লাহ্‌ প্রকাশ করেন ‘আউটলাইনস অফ দ্য হিস্টোরিক্যাল গ্রামার অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’।

সামাজিক দায়বদ্ধতা ও বাংলা ভাষাপ্রীতি
তাঁর সম্পর্কে অনেকেই অভিযোগ করেন, সমাজে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁর যে জ্ঞান ছিল, তা তিনি পরিপূর্ণভাবে দান করেননি। শ্রী সুকুমার সেন ‘শব্দশাস্ত্রবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌’ শিরোনামে এক লেখায় ইঙ্গিত দেন, ‘...দুঃখের বিষয়, এ রকম ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের দিকে শহীদুল্লাহ্‌ সাহেব বেশি পা বাড়ান নি। তিনি সাধারণ শিক্ষা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে—যা তাঁর মতো পণ্ডিত ব্যক্তির পক্ষে বাজে কাজ মনে হয়, তাতে লিপ্ত ছিলেন।’

পাণ্ডিত্যের উচ্চমার্গে থেকেও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি শহীদুল্লাহ। তাই বাংলা ভাষার ওপর কোনো রকম আক্রমণ তিনি বরদাশত করতে পারেননি। বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তা ছাড়া সামাজিক দায়িত্ব বোধ থেকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেকোনো চক্রান্ত বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করেন। ১৯৫১ সালের ১৬ মার্চ কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত বিদ্যালয় ও কলেজশিক্ষক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘... We educationist should however, emphatically protest and if necessary should revolt against the fresh impositon to any language other than Bengali as the medium of instruction for East Bengalee students. The imposition will be tentament to the genocide of East Bengalees...।’

১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা দিবসে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল থাকার সময় ছাত্রদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ১৯৫০ সালে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও দাঙ্গা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা নেন। বলাবাহুল্য, এক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে কাজ করেছিল সামাজিক দায়বদ্ধতা। ১৯৫০ সালে তাঁকে সভাপতি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদ, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘পূর্ববঙ্গ শান্তি ও পুনর্বাসিত কমিটি’ গঠন করা হয়। তাঁর উদ্যোগে ১৯৩৯ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নিখিল বঙ্গ প্রগতি লেখক সংঘ’। ১৯৪২–এ ঢাকায় সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির উদ্যোগে সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন সমাজ ও সভ্যতার বহুমুখী অগ্রগতি জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার জন্য ঢাকায় ব্যাপটিস্ট মিশনে এক চিত্র প্রদর্শনী হয়। এর উদ্বোধক ছিলেন শহীদুল্লাহ। তিনি এটার নামকরণ করেন ‘সোভিয়েট মেলা’। ১৯৪৩–এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে দুধ, বার্লি, খিচুড়ি ইত্যাদি বিতরণের জন্য তাঁর ৫ নম্বর উর্দু রোডের বাসায় রিলিফের কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন শহীদুল্লাহ্‌।

১৯৩৩ সালের ২৩ জানুয়ারি শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমিতির উদ্যোগে রামমোহন শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এবং ৮ শ্রাবণ দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘সাম্যবাদী বঙ্কিম’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ভারতের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ বাংলা হতে পারে কি না, এ ব্যাপারে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক সভায় বাংলার সপক্ষে প্রবন্ধ পাঠ করেন তিনি (মোসলেম ভারত, প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৭)। শহীদুল্লাহ্‌ বলেন, ‘...ইংরেজী, উর্দু, হিন্দির পর আবশ্যক সংস্কার করিলে বাঙ্গালাকে ভারতের সাধারণ ভাষায় পরিণত করা যাইতে পারে...’। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে তা মালা-তিলক-টিকি-তে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।’

অনেকেই শহীদুল্লাহ্‌র ধর্মনিষ্ঠতাকে পরোক্ষভাবে না হলেও আকারে ইঙ্গিতে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁর স্কুল পাঠ্যপুস্তক রচনা নিয়ে কথা তুলেছেন। বলে রাখা দরকার, শহীদুল্লাহ্‌ ১৩২৩ সালে যশোর-খুলনাসিদ্দিকিয়া সাহিত্য সমিতির সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘কি পরিতাপের বিষয় আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম, শ্যাম, গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভাল ছেলে। কাশেম বা আবদুল্লাহ কেমন ছেলে, সে তাহা পড়িতে পারে না।...তারপর সে তাহার পাঠ্যপুস্তকে রাম-লক্ষ্মণের কথা, কৃষ্ণাজ্জু‌র্নের কথা, সীতা-সাবিত্রীর কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদিগের বই আখ্যান পড়িতে থাকে। স্বভাবতঃ তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি,...হিন্দু বালকগণ ঐ সকল পুস্তক পড়িয়া মনে করে, আমাদের অপেক্ষা বড় কেহ নয়। মুসলমানেরা নিতান্ত ছোট “জাত”।’ উদাহরণযোগে তিনি বলছেন, স্কুলে একজন মুসলমান ছাত্র, সে যখন পড়ে রাম ভালো ছেলে, কিন্তু রহিম কেমন, তা জানতে পারে না, তখন ওই ছাত্রের মধ্যে হীনম্মন্যতা জন্মে। শহীদুল্লাহ্‌ তাই এই বৈষম্য ও হীনম্মন্যতা ঘোচাবার জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। সুষম মুসলমান সমাজ গঠনে তিনি এই কাজগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। সময় দিয়েছেন। এগুলো যদি গুরুত্বপূর্ণই না হবে, তাহলে রবীন্দ্রনাথই বা কেন পাঠ্যপুস্তকের মতো শিশু-কিশোরদের জন্য বহু বই লিখতে গেলেন?

হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা। সেই লক্ষ্যে শিশুসাহিত্য মাসিক আঙুর তাঁর সম্পাদনায় বৈশাখ ১৩২৭ সালে কলকাতার ৫-এ কলেজ স্কোয়ারের মখদুমী লাইব্রেরি থেকে বের হয়। এই পত্রিকার হেডপিসে ছিল হিন্দু ও মুসলমান দুই বালকের ছবি।

শহীদুল্লাহ্‌ মুসলমান হয়েও হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রহ ছিল বলেই ‘মদনভস্ম’ (১৩১৬), ‘কবির সাহেব ও হিন্দুধর্ম’ (১৩২৫), ‘ভরত, কণ্ব ও বিশ্বামিত্র’ (১৩৫৩), ‘শ্রীমদ্ভগবদ গীতার একটি পাঠান্তর’ (১৩৬৩), ‘গীতা ও শ্রীকৃষ্ণ তত্ত্ব’ (১৩৬৪) প্রভৃতি প্রবন্ধ রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গভীরভাবে জানার জন্য পাঠ করেন ভগবতপুরাণ, শিবপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, মাৎস্যপুরাণ, বায়ুপুরাণ প্রভৃতি পুরাণসহ চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল মনসামঙ্গল।সৈয়দ আলী আহসান শহীদুল্লাহ্‌র ধর্মচেতনা সম্পর্কে বলেন, ‘প্রচার ধর্মবোধ থেকেই তাঁর মধ্যে একটি পরমত-সহিষ্ণুতা গড়ে উঠেছিল। তিনি বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণকে কখনো অগ্রাহ্যের চোখে দেখেননি। পাকিস্তান আমলে ঢাকা বোর্ডের ম্যাট্রিকের পাঠ্যপুস্তক কমিটির এক সভায় ভারতচন্দের কাব্যাংশের প্রশংসা করেছিলেন, যেখানে মহাদেব, অন্নপূর্ণা এদের কথা ছিল...।’ (‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, স্মৃতিগত তাৎপর্য’)

শহীদুল্লাহ্‌ বিশ্বাস করতেন, হিন্দু-মুসলমানের প্রকৃত সম্প্রীতি সম্ভব হতে পারে একমাত্র সাহিত্যের মাধ্যমে। তাই তিনি বলেন, ‘...যেদিন বাংলার হিন্দু সাহিত্য ও বাংলার মুসলিম সাহিত্য গঙ্গা-যমুনার ন্যায় মিলিত হয়ে উভয়ের হৃদয়ে মিলন সম্পাদন করবে সেই দিনই বাংলা সাহিত্য পূর্ণ হবে।’ (নেত্রকোনার মুসলিম সাহিত্য সম্মিলনীর অভিভাষণ, ১৯২৯)। শহীদুল্লাহ্‌ ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম মুসলমান ছাত্র সম্মিলনে সভাপতির ভাষণে দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘...তোমরা বাঙালী। তোমরা বাঙালী মুসলমান। বাঙ্গলার আবহাওয়ায়, বাঙ্গালার মাটিতে, বাঙ্গালার শষ্যে, বাঙ্গালার ফলে তোমাদের দেহ গঠিত, পুষ্ট বৃদ্ধিতে। খুব সম্ভবতঃ এই বাঙ্গালার ক্রোড়ে তোমাদের শরীর চিরনিদ্রায় শায়িত হইবে।...’

তিনি মনে–প্রাণে বাঙালি ছিলেন বলেই ১৯১৭ সালে দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে বলছেন, ‘হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাঙালী জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। বাঙালী হিন্দু বাঙালী মুসলমান ব্যতীত চলিতে পারিবে না। বাঙালী মুসলমান বাঙালী হিন্দু ব্যতীত চলিতে পারিবে না। চিরকাল কি এভাবেই যাইবে? জগতের ইতিহাস পৃষ্ঠে কি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালী জাতি, ফরাসী, ইংরাজ, ইতালিয়ান, জর্মন, জাপানী প্রমুখ জাতির ন্যায় নাম রাখিতে পারিবে না? আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে পারিবে।’ এগুলো বাঙালির নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথের বলার কথা, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু কিংবা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বলার কথা। তবে তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো ৫৪ বছর পর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলিত বাঙালি জাতির একটি ভূখণ্ড স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে।

উর্দুর বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান
১৯৪৭ সালে জুলাই মাসে উদু‌র্কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে প্রস্তাব করেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ। এ প্রেক্ষিতে শহীদুল্লাহ্‌ সাপ্তাহিক কমরেড পত্রিকায় ‘দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ প্রব্লেমস অফ পাকিস্তান’ শিরোনামে লেখেন, ‘...To surrender Bengali to Urdu or Hindi as the language of the court and the university will be a shameful surrender of Bengal to outsiders which will be as if not noise than political subjugation...’।

এই লেখায় তিনি‌ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জিয়াউদ্দীন আহমদের প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেন। পরে জিয়াউদ্দীন সাহেবকৃত ওই সুপারিশের অসারতাগুলো সাধারণের কাছে অবহিত করার জন্য দৈনিক আজাদ (১৭ শ্রাবণ ১৩৫৪) পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক আরও একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষারূপে প্রবর্তন করার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১ সালে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, গণপরিষদ সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মচারী, লেখক, শিল্পী, ছাত্র, পুস্তকপ্রণেতা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে স্মারকলিপি প্রদান করেন, তার মধ্যে শহীদুল্লাহ্‌ ছিলেন অন্যতম। তাঁর প্রতি সরকারি চাপ ছিল, যেন তিনি উর্দুর পক্ষে কথা বলেন। কিন্তু তিনি বললেন উল্টো কথা, উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে দিলেন চমৎকার এক যুক্তি, ‘উর্দু যদি ইসলামী ভাষা হয়ে থাকে, তাহলে আরবী ভাষাই হচ্ছে ইসলামী ভাষা। সে ক্ষেত্রে আরবী ভাষা রাষ্ট্রভাষা হউক।’ সেই সময়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান তাঁকে বাংলা ভাষা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে বারণ করেছিলেন এবং তাঁকে ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এ সময় শহীদুল্লাহ্‌ বলেছিলেন, ‘...আমার সারাজীবনের সাধনা তুচ্ছ একটা পদের জন্য আমি ব্যর্থ হতে দেবো আপনি ভাবছেন? তার চাইতে আমি একটি প্রাইমেরি স্কুলের শিক্ষক হয়ে বাকী জীবন কাটাবো, তা কি ভাল নয়?’ (‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, বাংলার বাণী, ১০ মার্চ ১৯৯৫)।

পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ইসলামি ভাবধারায় গঠন করে আরবি হরফে বাংলা প্রচলন করার জন্য কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান শহীদুল্লাহ্‌কে চিঠি দিলে তিনি চিঠির প্রত্যুত্তর না দিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা দ্য স্টেটসম্যান-এ চিঠিটির সারমর্ম প্রকাশ করায় সরকার তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে।

কেবল এতেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন’ থেকে ১৯৬২–এর ১৫ মার্চ শহীদুল্লাহকে সম্মানীয় ফেলোশিপ দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়, কিন্তু পাকিস্তান সরকারের আপত্তিতে তিনি তা গ্রহণ করতে পারেননি। প্রসঙ্গত বলা যায়, এই ফেলোশিপের তালিকায় ছিলেন আর্ল সি আর অ্যাটলি, অধ্যাপক লুইস র‍্যানন, ড. ডি টি সুজকি, ড. আর্নল্ড জে টয়েনবি ও অধ্যাপক গুইসেপ তুসির মতো সম্মানিত ব্যক্তি।

অন্য আলোয়

অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটা লেখায় এমন পড়েছি যে প্যারিসে গিয়ে তিনি শহীদুল্লাহ্‌কে বললেন, শহীদুল্লাহ্‌ সাহেব, স্বরাজ তো আসছে! তখন শহীদুল্লাহ্‌ বললেন, স্বরাজ তো হবে। তারপর কী হবে, জমিদারি থাকবে, না উঠে যাবে? শহীদুল্লাহ্‌র এ প্রশ্নের উত্তরে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘ও কথা আমি চিন্তা করিনি। কিন্তু তিনি (শহীদুল্লাহ্‌) তো তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।’

দেশের দরিদ্র চাষিদের করুণ অবস্থা যে তাঁর মনকে বিচলিত করে, তা আমরা লক্ষ করি ১৯২৮ সালে নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম যুবক সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে, ‘...লম্বা ছুটির সময় তোমরা কি চাষীদের মধ্যে গিয়ে কাজ করতে পার না? স্বদেশ প্রীতি কি কেবল মুখের কথা হয়ে থাকবে? মনে রাখতে হবে, যে পর্য্যন্ত না দেশের সাড়ে পনরো আনা এদের হবে, যখন এরা নিজেদের দাবী–দাওয়া কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতে পারবে, তার আগ পর্যন্ত প্রকৃত স্বরাজ হবে না...।’

বেগম সারা তৈয়ফুরের লেখায় আছে, যখন মেয়েদের ঈদের জামাতের ইমামতি কেউ করতে চাননি, তখন শহীদুল্লাহ্‌ নিজে গিয়ে বলেছেন, আমি ইমামতি করব। কার্জন হলের মাঠে সেই ঈদের জামাতে তিনি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর পেছনে ছিল লম্বা পর্দা, কারণ, তাঁকে যেন দেখা না যায়। শহীদুল্লাহ্ ইমামতি করলেন। পেছনে সারিবদ্ধভাবে ছিলেন নারীরা।

১৯৩৭–এ চাঁদপুর মুসলিম যুবক সমিতির একাদশ সাধারণ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, ‘...এ প্রসঙ্গে পর্দ্দার কথা আসবে—আমি পর্দ্দার বিরোধী নই; কিন্তু প্রত্যেক জিনিসেরই একটা সীমা আছে। মনে করুন কোনও মুসলমান নারীর জীবন রক্ষার জন্য পুরুষ চিকিৎসকের দ্বারা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়েছে, এখানে কি পর্দ্দার দোহাই দিয়ে মেয়েটিকে মেরে ফেলতে হবে? শরী’অত তো তেমন বিধান দেয় না ...’। শহীদুল্লাহ্‌ মনে করতেন, ‘...নারী পুরুষের ভোগের জিনিস নহে, তাহারা আদরের পুতুল নহে, পুরুষকায়ার ছায়া নহে। জীবন যুদ্ধে নারী পুরুষের সহযোগিনী, জীবনের লক্ষ্যপথে নারী-পুরুষের সহযাত্রিণী। নারী যদি পুরুষের দাসী হয়, তবে পুরুষও নারীর দাস, ইসলামে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক—এইরূপ স্বীকার করে। পুরুষের আত্মগ্রাসিনী নীতির ফলে নারীর স্বত্ব খর্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু সেদিন আসিবেই যেদিন মুসলিম মহিলা কুর’আনের দোহাই দিয়া, হাদীসের দৃষ্টান্ত দিয়া তাহার ন্যায্য স্বত্ব অধিকার করিবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘...মানবদেহে যেমন দুই চোখ, দুই হাত, দুই পা, সমাজ দেহে তেমনি নর–নারী। যে দেহে এক চোখ কানা, এক হাত নুলা, এক পা খোঁড়া সে দেহ বিকলাঙ্গ, নারীজাতির সুষ্ঠু উন্নতি ব্যতীত সমাজকে সমুন্নত বলা যায় না...।’

১৯৬২ সালের ২৭ মে আমার বিয়ে পড়িয়েছেন তিনি, বাবা—আমার বাবু। সেদিন আরবিতে খুতবা পড়ে তারপর আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাকে কী বললাম এটা তো তোমার জানা উচিত। কী দায়িত্ব দেয়া হলো।’ অতএব, তিনি আবার পুরো বাংলায় তরজমা করলেন।

এমন একটা চিঠি নেই, যেখানে শহীদুল্লাহ্‌ ওপরে লিখেছেন ‘এলাহী ভরসা’, ‘আল্লাহ ভরসা’, ‘৭৮৬’। অথচ ভূরি ভূরি চিঠি রবীন্দ্রনাথের, যার ওপরে ‘ওঁ’ লেখা। শুধু তা-ই নয়, শহীদুল্লাহ্‌ যখন প্যারিস থেকে ফিরে এলেন, ১৯৩০ সালে তাঁর প্রথম কন্যা, আমার বড় বোনের বিয়ের কার্ডের ওপরে লেখা ছিল ‘আল্লাহ জয়তি’। যেখানে সাধারণত লেখা হতো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, ‘পরম করুণাময় আল্লাহর নামে’, কিংবা ‘এলাহী ভরসা’। অনেকে তখন মনে করেছেন, যেহেতু তিনি সদ্য প্যারিস-প্রত্যাগত, অতএব, কিছুটা আধুনিকতা। আর ১৯৩৮ সালে আমার ছোট বোনের যখন বিয়ে হলো, সেই কার্ডের ওপরে লেখা ছিল ‘এক’। মানে আল্লাহ এক, রসুল এক। তখন তো তিনি রীতিমতো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। ফুরফুরা পীর সাহেবের গদিনসিন খলিফা। আবার ১৯৬২–তে আমার বিয়ের কার্ডের ওপরও লেখা ছিল ‘এক’।

বাবা রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন‌। মনে আছে, যখন সেভেনে পড়ি, দেয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের ছবি ছিল আমাদের বাড়িতে। সেটা দেখিয়ে মা বলতেন, এটা কার ছবি, বলো তো? দেখে মনে হতো আমার বাবার মতোই, বাবরি চুল–দাড়ি। আমি বলতাম, কেন, এটা তো বাবু। মা বলতেন, না না। এটা রবিঠাকুর। আগেই বলেছি, বাবাকে আমরা বাবু বলতাম। তো বাবু প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা বলি। তিনি যখন বগুড়ায় আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ, তাঁর কাছে আসা ছাত্র ও অধ্যাপকেরা তাঁর কথা জিজ্ঞেস করলে বলতাম, বাবু? তাঁরা ভাবতেন, আমি বাসার চাকর। হোলির সময় হিন্দু ছাত্ররা তাঁর হাতে আবির দিলে তিনি তা সাদরে গ্রহণ করতেন, ক্ষুব্ধ হতেন না।

আদতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ যতটা মুসলমান ছিলেন, তার চেয়েও বেশি ছিলেন বাঙালি।

জন্মের পর আকিকায় পিতা মুনশী মফিজুদ্দীন আহমদ তাঁর নাম রেখেছিলেন মুহম্মদ ইব্রাহীম। কিন্তু যেহেতু মহররমের চাঁদে গর্ভে এসেছিলেন, তাই তাঁর মা হুরুন্নেসা নামকরণ করেন শহীদুল্লাহ্‌। এই নিষ্ঠাবান ধর্মপ্রাণ পরিবার বংশপরম্পরায় পীর গোরাচাঁদের খাদেম ছিলেন। সাধক পেয়ার শাহর নামানুসারে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার তাঁর গ্রামের নাম ছিল পেয়ারা।

১৯৬৯ সালে বাবার মৃত্যুর এক কি দুদিন আগে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার ‘শেষের পাতা’র কলামে হেদায়েত হোসেন মোর্শেদের একটি লেখা বেরিয়েছিল। সেখানে শহীদুল্লাহ্‌কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি জাতির উদ্দেশে কি কিছু বলবেন। তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে যে কথাটি বলেছিলেন, তা তাঁর আজীবনের সাধনা বাংলা ভাষায় নয়, ছিল ইংরেজিতে: ‘আই উইল সুন বি ফরগটেন’।