ফিদার জন্য...

শিল্পী: আজমল হোসেন
শিল্পী: আজমল হোসেন

চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন শুধু দর্শকসংগ্রাহকের মনোযোগ আকর্ষণ একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে না, কখনো কখনো মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করার পাশাপাশি ব্যাধিমুক্ত করতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের ছাত্র সৈয়দ ফিদা হোসেনের চিকিৎসায় অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সৈয়দ ফিদা ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর কাজের মাধ্যমে শিল্পকলার অঙ্গনে স্থান করে নেন। দুরারোগ্য ব্যাধি ফ্যামিলিয়াল কলোনিক পলিপসিস ক্যানসার তাঁর জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। ফিদার অগ্রজ ও অনুজ বন্ধুরা যাঁরা আঁকিয়ে—এ রকম ১০০ জনের অংশগ্রহণের বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন তেলরং, জলরং, অ্যাক্রিলিক, প্লাস্টার, কাঠ, সিমেন্ট, এচিং উডকাটে করা ১২০টি শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর এই আয়োজন। প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমা দেওয়া হবে সৈয়দ ফিদা হোসেনের চিকিৎসা তহবিলে। চারুকলার শিক্ষার্থীদের এ প্রদর্শনীতে একাডেমিক রীতির কাজের আধিক্য থাকলেও সংগ্রাহকদের জন্য প্রাপ্তি হচ্ছে সাধ্যের মধ্যে নিরীক্ষাধর্মী ও বাস্তবধর্মী কাজ সংগ্রহের জুতসই সুযোগ পাওয়া। শিল্পীদের নানা মাধ্যমে এ কাজের ভিড়ে এক দেখাতেই কিছু কাজ আলাদা করে দেখা যায়। যদিও এ প্রদর্শনীর কাজগুলোর উপস্থাপনে একধরনের অগোছালো প্রক্রিয়া বোঝা যায়। তবু এটিকে মহতী উদ্যোগের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়। প্রদর্শনীর কাজ নিয়ে আয়োজকদের মত, যেহেতু এ প্রদর্শনী একটি প্রাণ বাঁচানোর লড়াই, তাই সব শিল্পী তাঁদের ভালো শিল্পকর্মটিই প্রদর্শন করছেন। বন্ধুর জীবন বাঁচাতে অনন্য এ নজির স্থাপন করতে শিল্পীরাই যে পারেন, তার প্রমাণ অতীতের মতো এবারও মিলল।

শিল্পী: সুখেন্দু দাস
শিল্পী: সুখেন্দু দাস

 প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া সিমেন্টে গড়া বিপ্লবী চের আবক্ষ মূর্তি গড়েছেন মনীন্দ্রনাথ। বাস্তব রীতিতে চের ঊর্ধ্বমুখী দৃষ্টির এ ভাস্কর্যে ব্যক্তিত্ব আর সামরিক পোশাকের নির্মাণে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। কাগজে কালি ও কলমের দ্রুত রেখা ও ওয়াশে আজমল হোসেন ঘোড়ার অবয়ব এঁকেছেন। ঘোড়ার দ্রোহী ভঙ্গি ও চাহনি আজমল তাঁর শিল্পকর্মে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। সুখেন্দু দাস চারুকলার সবুজ আঙিনা অ্যাক্রিলিক রঙে এঁকেছেন। নিসর্গ চিত্রের বাস্তব নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। গাঢ় ও হালকা সবুজের গাছগাছালিতে প্রকৃতির সতেজ রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তানভীর জালাল মানুষের দেহে চলতে থাকা অস্থিরতাকে প্রধান করে ক্যানভাস গড়েন। ঊর্ধ্বমুখে মানুষের দেহের কৌণিক দুই হাতের অবস্থান ক্যানভাসকে পূর্ণতা দিয়েছে। তানভীর জালালের ক্যানভাসে মানুষই প্রধান চরিত্র। ক্যানভাসের দুই পাশে টাইপোগ্রাফিতে স্টপ, টক শো এমন বার্তা আমাদের অস্থির সময়ের কথা বলে। বুবলি বর্ণা গোলাপি জমিনের ক্যানভাসে দুজন মানবীর পায়ের রূপ প্রকাশ করেছেন। একজন মানবীর পায়ের হুবহু অবস্থান দর্শকদের মাঝে কৌতূহল তৈরি করেন। গোলক ও উল্লম্ব কাঠের তৈরি আকৃতির সঙ্গে অর্ধবৃত্তাকার ফর্মের বাইরে রেখা নির্মাণ করেছেন তরুণ শিল্পী আল-নাসির। মানবযুগলের মুখাবয়ব গড়েছেন রামিজ আফরোজ। প্লাস্টারে গড়া বাস্তবধর্মী দুজন মানুষের অভিব্যক্তি দুই রকম—একজন কথোপকথনের ভঙ্গিতে অন্যজন শান্ত অবয়বে স্থির দৃষ্টিতে থিতু হয়ে আছেন। এই ভাস্কর্য যুগলে মানবজীবনের ক্লান্তিকর দিনাতিপাত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঝাঁকড়া চুলের মানুষটির মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। প্রতিকৃতিটি সৈয়দ ফিদা হোসেনের আঁকা। প্রদর্শনীর দেয়ালে সবচেয়ে বড় আকৃতির ক্যানভাসটি ফিদার করা। এ ছবিকে শুধু একটি প্রতিকৃতি বলে শেষ করা যায় না। মানুষটির ঝাঁকড়া চুলের সঙ্গে সফেদ দাঁড়ি-গোঁফের এরকম আকৃতি, আমাদের ভাবনাকে উসকে দেয়। মানুষের জাগতিক মোহ ছিন্ন করে এ শহরে হয়তো এসেছিলেন স্বপ্ন নির্মাণে। স্বপ্নভুক মানুষটি আকাশে তাকায়।

শিল্পী ফিদা হোসেন মানুষের যন্ত্রণা বোঝেন, তাই তাঁর ক্যানভাসে দেখা যায় আর্তি। বান্ট সিয়েনা রঙের আধিক্যে আলোছায়ার বাস্তব প্রক্ষেপণে গড়ে তুলেছেন এই মানুষের মুখ।

মানুষের মুখের মাঝে শিল্পী ফিদা হোসেন আনন্দ-বেদনা খুঁজতেন। তারই সাক্ষ্য দেয় তাঁর আঁকা ক্যানভাসগুলো। স্বল্প সময়ে বেশ কিছু পুরস্কার প্রাপ্তি ফিদার কাজের স্বীকৃতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বন্ধুদের রোগমুক্তির এই আয়োজনে ফিদা নিশ্চয়ই মুক্ত হবেন দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে। চিত্রকর্ম কেনার মাধ্যমে সংগ্রাহক ও শিল্পরসিকজন এ মহতী উদ্যোগে যুক্ত হতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে ১৪ জুলাই শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হয় ২৩ জুলাই।