দুলিচাঁপা তোমার জন্য

রমনায় দ্বিজেন শর্মা, ছবি: সৈকত ভদ্র
রমনায় দ্বিজেন শর্মা, ছবি: সৈকত ভদ্র

কুসুমবীথির নিশ্ছিদ্র পাতায় ছাওয়া রমনার পায়ে হাঁটা পথ। লাগোয়া হেয়ার রোডে শতবর্ষী দুর্লভ পাদাউকের সারি। বর্ষার ধোয়ামোছা পত্রপল্লবে সুশোভিত চারপাশ। পার্কের অরুণোদয় গেটের পাশে একটি সুউচ্চ কুসুমগাছের নিচে বসে আছেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। দিনটি ছিল ৮ জুলাই। আমি অনেকটা ছুটতে ছুটতেই তাঁর সামনে গিয়ে থামি। কারণ, বিশ মিনিট বিলম্ব। দাদা স্মিত হাস্যে বললেন, ‘ও, এসে পড়েছ। চলো, আমরা হাঁটতে শুরু করি।’ এমনটা প্রায়ই হয়। আমরা পার্কে এসে গল্প করতে করতে গাছগুলো দেখি। ওদের বাড়বাড়ন্তের খবর রাখি, সময়মতো ফুল ফুটেছে কি না, তা নিয়েও আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। গল্প করতে করতে আমরা মাকড়িশালের পাশে এসে দাঁড়াই। দাদা বললেন, ‘এই গাছটি লাগানোর কথা কি মনে আছে তোমার?’ আমি বলি, দিব্যি মনে আছে, এই তো সেদিনের কথা। তা-ও আট বছর হলো। মাকড়িশালের আরেক নাম বনাক। শালবনের বিপন্ন প্রজাতির গাছ। জানামতে, ঢাকায় আর একটিও নেই। ঘুরতে ঘুরতে আমরা এসে দুলিচাঁপার পাশে দাঁড়াই। বাংলাদেশের একমাত্র বুনো ম্যাগনোলিয়া। বড় বড় পাতার গাছটি হাওয়ায় দোল খেতে খেতে আমাদের কথার সঙ্গে তাল মেলায় যেন। দাদা বললেন, ‘মাকড়িশালের সঙ্গে একই দিন লাগিয়েছিলাম গাছটি।’ দিন কয়েক পরে কার্জন হল লাগোয়া উদ্ভিদ উদ্যানেও লাগানো হয় আরেকটি। কার্জন হলের গাছটিতে ফুল ফুটছে তিন বছর ধরে। এ দুটি ছাড়া ঢাকায় দুলিচাঁপার আর কোনো গাছ নেই।

পার্কে সকালের ভিড়টা কমে এসেছে। আমরা খানিটা বাঁ দিকে ঘুরে বুনো আমের বীথি ছাড়িয়ে আরেকটু সামনে এগোই।

রমনায় দ্বিজেন শর্মা, ছবি: সৈকত ভদ্র
রমনায় দ্বিজেন শর্মা, ছবি: সৈকত ভদ্র

 কাছাকাছি চারটি গাছ—কনকচাঁপা, আগর, কাউয়াতুতি আর লেডিস আমব্রেলা। প্রথম তিনটি দাদার লাগানো গাছ। কাউয়াতুতি নিয়ে ঘটেছিল মজার ঘটনা। পারুল ভেবে যে চারাটি পাহাড় থেকে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা পারুল না হয়ে হলো কাউয়াতুতি। আর বাংলাদেশ শিশু একাডেমী বাগানের গাছটি হলো ধারমারা। হয়তো ভুল চারার কারসাজি! দাদার মুখে এই গল্প শুনতে শুনতে এখন মুখস্থ। তবে দুর্লভ কনকচাঁপার চারাটি রোপণ করা হয়েছিল কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। কারণ, গাছটির প্রতি দাদার আলাদা মমতা ছিল। কনকচাঁপার চারাটি সংগ্রহ করেছিলেন শিশু একাডেমীর বাগান থেকে। বাসার টবেই বড় হয়ে ওঠে গাছটি। একদিন ভাবলেন, টবে তো আর ওর ঘরসংসার হবে না। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে রমনায় রোপণ করা হলো গাছটি। তারপর নিজের অনুভূতির কথা লিখেছিলেন এভাবে, ‘বাড়ি ফিরি শূন্য হাতে, দেখি ওর জায়গাটা খালি, কিছুক্ষণ আগেও ছিল, এখন নেই। দুপুরের নিয়মিত ঘুম আর আসে না। বিকালের আগেই পার্কে ছুটে যাই। চারাটি দেখি, ভালোই আছে।’ সেই কনকচাঁপাটি কয়েক বছর ধরে পার্কে নিয়মিত ফুল দিচ্ছে। কনকচাঁপাকে বিদায় জানিয়ে আমরা নার্সারির পাশ ঘেঁষে অস্তাচলের দিকে যেতে থাকি। আমি বললাম, দাদা, আপনার আরেক কন্যা কিন্তু আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদা বললেন, ‘বুঝেছি, পালামের কথা বলছ।’ আমি মাথা নাড়ি। গাছটি নার্সারির ভেতর। এটিও পাহাড় থেকে নিয়ে আসা। গ্রীষ্মে গাঢ় লাল রঙের অসংখ্য ফুলে ভরে থাকে গাছটি। আমরা আর বেশিক্ষণ দাঁড়াই না। অস্তাচলের বাওবাবগাছটি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মরু অঞ্চলের এই গাছ আমাদের দেশে আছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি। দাদা গাছটির কাণ্ডে হাত রাখেন, তারপর ওপরে তাকিয়ে শুভ্রতায় মোড়ানো কয়েকটি বড় ফুল আবিষ্কার করে পুলকিত হন। দাদার সঙ্গে এভাবে ঘুরে ঘুরে গাছ দেখা নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রায় ১৬ বছরের নিয়মিত ঘটনা। তিনি বছর দশেক আগে প্রথম আমাকে বাংলাদেশের একমাত্র (জানামতে) ব্ল্যাকবিনের গাছটি দেখাতে নিয়ে যান। গাছটির অবস্থান রমনা পার্কের অদূরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার উত্তর পাশের সীমানায়। লাগোয়া মূল সড়কটি বেইলি রোড নামেই পরিচিত। সেদিন আমরা গাছটির কাণ্ড ও ডালপালাভরা উজ্জ্বল কমলা রঙের ফুল দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। পরে প্রথম আলোয় গাছটি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদনও লিখেছিলাম। আবার পয়লা ফাল্গুনে রমনার দুর্লভ মাধবীর সুবাস মেখে চারুকলার বসন্ত উৎসবে যোগ দেওয়ার গল্পও দাদার মুখে অনেকবার শুনেছি। তত দিনে আমরা আরও কিছু বিপন্ন ও দুর্লভ বৃক্ষ খুঁজে বের করি। বলধা গার্ডেনে খুঁজে পাই দেশের একমাত্র স্বর্ণ অশোকটি। দাদা বললেন, ‘অনেক ঘোরাঘুরি হলো, এবার চা-বিরতি।’ আমরা গাছতলায় বসি। অদূরে রমনা বটমূল। ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর ‘তরুপল্লব’-এর প্রথম ‘গাছ দেখা গাছ চেনা’ অনুষ্ঠান হয়েছিল এখানে। নগরের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষসহ শিক্ষার্থীদের বৃক্ষ ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করার জন্যই এমন একটি অনুষ্ঠানের কথা ভাবি আমরা। শুরু থেকেই এই কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন দ্বিজেন শর্মা। তরুপল্লবের মাধ্যমে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এ পর্যন্ত ১৪টি অনুষ্ঠান করেছি। তা ছাড়া বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়েও করেছি আরও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান। আমরা সুযোগ পেলেই বিপন্ন বৃক্ষগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়ি। দ্বিজেন শর্মা তাঁর সন্তানতুল্য গাছগুলোর পাশে দাঁড়ান, গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন, ওদের সঙ্গে কথা বলেন। কখনো কখনো আমরা বেঞ্চিতে বসে রমনার ঘনায়মান সন্ধ্যার পবিত্র রূপ প্রত্যক্ষ করি। তারপর একধরনের মগ্নতার ভেতর ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরি।