বাংলাদেশ সফরনামা

৮৭ বছর বয়সে ১৩ এপ্রিল মারা গেলেন জার্মানির নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক গ্যুন্টার গ্রাস। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বিশ্বসাহিত্যে তাঁর উপস্থিতি ছিল প্রবল। ১৯৮৬ সালে এসেছিলেন বাংলাদেশে। ঘুরেছিলেন এ দেশের আনাচকানাচে। পরে সেই অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন নিজের ভ্রমণপঞ্জিতে। তাঁর মৃত্যুর পর পুনর্মুদ্রিত হলো গ্যুন্টার গ্রাসের বাংলাদেশ সফরের বৃত্তান্ত

গু্াযন্টার গ্রাস (১৬ অক্টোবর ১৯২৭—১৩ এপ্রিল ২০১৫), জার্মানির নিজ বাসভবনে দেখছেন নোবেল পুরস্কার জয়ের পর প্রকাশিত প্রথম আলোর ‘শুক্রবারের সাময়িকী’। ছবি: হান্স গ্রুনার্ট
গু্াযন্টার গ্রাস (১৬ অক্টোবর ১৯২৭—১৩ এপ্রিল ২০১৫), জার্মানির নিজ বাসভবনে দেখছেন নোবেল পুরস্কার জয়ের পর প্রকাশিত প্রথম আলোর ‘শুক্রবারের সাময়িকী’। ছবি: হান্স গ্রুনার্ট

এখন রাত, ঠান্ডা। আমরাও কম্বলের নিচে শুয়ে আছি। গতকালের স্কেচগুলো ব্যবহার করে সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ কাজ করেছি, একটি বস্তি আঁকছিলাম, রাতারাতি যেন সেটি গজিয়ে উঠেছে, এক কারখানার দেয়াল ঘেঁষে, একটি মাত্র খুঁটির ওপরে। দারিদ্র্যের (অলিখিত) নন্দনতত্ত্ব আবার আঘাত করে আমাকে: ন্যাকড়া, প্লাস্টিকের পাত, কার্ডবোর্ড, ছালা ইত্যাদি দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা পর্ণকুটির; ভয়ংকরভাবে অনুভূতিকে স্পর্শ করে, চিৎকার করে একটা নামের জন্য। এই চূড়ান্ত সুন্দর চ্যালেঞ্জ করে সৌন্দর্যের অন্য সব নিয়মকে।
বাংলাদেশ-ভ্রমণের বিবরণে যাওয়ার আগে—যেখানে দাউদ হায়দারের ১৪ ভাইবোন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে—আমি কিছু মুখমণ্ডল ধরতে চাই; হতোদ্যম উদ্বেগ আর জমাটবাঁধা গাম্ভীর্যভরা সেসব স্বত্বহীন পরবাসী মানুষের মুখ, যারা আর কাজ করে না, যাদের আর কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করার নেই। মধ্যবিত্তরা কতটাই না অবয়বহীন, কী তাড়াতাড়িই না তারা মেদসর্বস্ব হয়ে পড়ে! আমার যা কিছু দেখানোর আছে, যা কিছু আমি বলব, তা শুধু এটুকুই প্রমাণ করবে যে আমি ছিলাম কেবল এক দর্শক, তার বেশি কিছু নয়।
গভীর রাতে আবিষ্ট হয়ে একটি চটিবই পড়ছিলাম। গৌরকিশোর ঘোষের লেট মি হ্যাভ মাই সে, ইন্দিরা গান্ধীর সন্ত্রাসের রাজত্বকালে লেখা নকশালদের পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদও সমানভাবে রয়েছে বাইটিতে। দুই শিবিরের মাঝখানে অসহায় এক গণতন্ত্রী...
(কলকাতা বিমানবন্দরের) নিরাপত্তা গেট—আমাদের সামনে মাত্র আধা ঘণ্টার বিমানযাত্রা—এক শুল্ক কর্মকর্তা আনমনে আমার সিগারকেস থেকে দুটো সিগার হাতিয়ে বললেন: ব্রাজিলীয় সিগার তাঁর খুব পছন্দ। আমাদের প্রস্থান ও প্রত্যাবর্তনের জন্য দরখাস্ত লেখা হয়নি। লিখিতভাবে আমি সেটা জানালাম, কিন্তু ভারতে আমাদের অবস্থানের অনুমতিপত্র বিমানবন্দর পুলিশ রেখে দিল। এই ভুলের আমলাতান্ত্রিক পরিণতি আমাদের ভোগ করতে হবে ইউরোপে প্রস্থানের আগ পর্যন্ত।
৬০ লাখ লোকের এক মফস্বলি শহর, একটি দেশের রাজধানী, যে দেশ আয়তনে বাভারিয়্যর প্রায় দ্বিগুণ, কিন্তু লোকসংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি, প্রতিবছর এ সংখ্যা তিন শতাংশ হারে বাড়ছে। পড়তে ও লিখতে জানে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ। ১৯৪৬-৪৭ সালের নরমেধযজ্ঞ বা ১৯৭১ সালের লোকক্ষয়—বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা লাভ করে—কোনো কিছুতেই এই পরিসংখ্যানের উন্নতি ঘটেনি, ফি-বছরের বন্যা ও তার পরবর্তী মহামারিতেও নয়।
কলকাতার চেয়ে এখানে মোটরগাড়ি কম, কিন্তু অনুমোদিত রিকশাই আছে এক লাখের মতো। হাওয়া কলকাতার চেয়ে ভালো, রাস্তাঘাটে আবর্জনা কম, গরু-বাছুর পথ রোধ করে নেই। আর শহরে প্রবেশের রাস্তাগুলো প্রশস্ত, সামরিক কুচকাওয়াজের উপযোগী, খানাখন্দ নেই।
ঢাকা বিমানবন্দরে একদল লেখক ফুল দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। খাওয়া-দাওয়ার পর (চীনা খাবার) মশারি ছাড়াই আমরা ঘুমাই এবং ন্যাংটা বোধ করি। পরদিন সকালে জমকালো রঙে ছবি আঁকা রিকশায় চেপে পুরোনো শহরে যাত্রা। ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষিতে কিছু সময় যায়। বেলাল চৌধুরী, একজন লেখক, আমাদের গাইড।
মুসলিম এই নগরে রাস্তাঘাটে পুরুষের সংখ্যা বেশি, শুধু একটি অংশে এর ব্যতিক্রম, সংখ্যালঘু হিন্দুদের যেখানে বাস। দাউদ হায়দারের মতো বেলাল চৌধুরীও আমাদের অনায়াসে নিয়ে যান কয়েকটি কারখানায়, পরিচয় করিয়ে দেন কিছু পরিবারের সঙ্গে। খুবই ঘিঞ্জি একটি বাড়ি, তক্তার ছাউনি দিয়ে সেটাই একটুখানি বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে এক যুবক আলমারির মতো একটা সিন্দুক খুলে দেখালেন গোপন গৃহবেদী: ওখানে টুকিটাকি সামগ্রীর মধ্যে দুর্গা, গণেশ আর লক্ষ্মী। আর আছে মশারিসমেত একটা পুতুলের খাট, ঘুমানোর সময় হলে সে খাটে দেবদেবীদের শুইয়ে দেওয়া হয়। নতুন করে হত্যা আর লুণ্ঠনের আশঙ্কা হাসিমুখে নাকচ করে যুবকটি, সে আশঙ্কা তেমন নেই। অনেকগুলো ছেলেমেয়ের একটি পরিবার।

স্ত্রী উেট গ্রাসের সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলা দেখছেন গ্যু ন্টার গ্রাস। জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা ১৯৮৬। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
স্ত্রী উেট গ্রাসের সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলা দেখছেন গ্যু ন্টার গ্রাস। জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা ১৯৮৬। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

তারপর সেসব কারখানা, যেখানে লোহার পাত দিয়ে সামুদ্রিক ঝিনুক কেটে কেটে বালা, চুড়ি ইত্যাদি বানানো হয়। একটি কাঠের টুকরোর সঙ্গে বাঁ পায়ে ঝিনুক চেপে ধরে বুড়ো আঙুলের ঠিক পাশেই দুহাতে করাত চালানো। করাতের পাতটি ধাতব হলেও কাজের পদ্ধতিটি প্রস্তরযুগীয়। পরে আমরা দেখতে গেলাম মোগল যুগের বিশাল লালবাগ কেল্লার অবশেষ। খুব দীনহীন একটি জাদুঘর সেখানে আছে। বেশি কিছু সেখানে না থাকলেও অন্ততপক্ষে তার দৈন্যদশা এই সাক্ষ্য দেয় যে, সংস্কৃতিলোলুপ ইংরেজরা কী নির্মমভাবে তাদের নিজেদের জাদুঘরগুলো সমৃদ্ধ করেছে—যার তুলনা বৃহত্তর জার্মানির ফিল্ড মার্শাল গ্যোরিং, বিদেশি জাতিসমূহের নান্দনিক সম্পদের প্রতি তার ভালোবাসা।
সেদিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা বৈঠক। বিষয় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিকল্পিত বিনাশ: বাঙালি জাত্যভিমান কোনো জাতীয় সীমারেখা মানে না। বাংলাদেশের ভেতরে তার এই বিনাশ অভিযানের কোনো প্রকাশ্য সমালোচনা সহ্য করে না সামরিক সরকার। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোও ‘উপজাতীয়’দের ভাগ্য নিয়ে তেমন চিন্তিত নয়। এখানেও (কলকাতার মতোই) বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক সংগ্রাম এত তীব্র যে নিজের পরিবার বা গোষ্ঠীর বাইরে কাউকে সহানুভূতি জানানোর কোনো অবকাশ নেই।
একটি নিমন্ত্রণ ছিল—বেলাল চৌধুরী যেটি গ্রহণ করেননি, এবং সংগত কারণেই—অন্য কয়েকজন লেখকের সঙ্গে, সাহিত্য-অনুরাগী এক শিল্পপতির বাড়িতে। শিল্পপতির স্ত্রী হারমোনিয়াম বাজিয়ে ফ্যাসফেসে গলায় পর পর দুটো রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনালেন। খাওয়ার সিময় কথাবার্তার একপর্যায়ে এমন সব প্রশ্ন উঠে এল, যেগুলোর উত্তরের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না। রাজনৈতিক নানা কথাবার্তা, ঘটনার উল্লেখ ইত্যাদি উপভোগ করতে করতে একসময় আমরা মূল বিষয়ে যাই। বাংলা যদিও চিরতরে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং একমাত্র সে কারণে তা জার্মানির সঙ্গে তুলনীয়, তবু সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি যে ভক্তি প্রকাশ করা হলো তা অবিভক্ত, সন্দেহের অতীত।

পুরান ঢাকায় গ্যু ন্টার গ্রাস, ১৯৮৬। ছবি: নাসির আলী মামুন
পুরান ঢাকায় গ্যু ন্টার গ্রাস, ১৯৮৬। ছবি: নাসির আলী মামুন

পরদিন গেলাম কুমোরদের ওখানে। কুমোরেরা শিগগিরই বেকার হয়ে পড়বে, কারণ প্লাস্টিকের ঘটি-বাটিতে বাজার দিন দিন সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। কুমোরদের বস্তির পেছনে প্রশস্ত একটি নদীর দৃশ্য। একটি চড়ায় বেদেদের তাঁবু—সাপ, ঝিনুক, শামুক, গাছ-গাছড়ার টোটকা ইত্যাদি নিয়ে যাদের কাজ-কারবার। পুরোভূমিতে মাল খালাস করা হচ্ছে একটি জাহাজ থেকে। পরস্পর যুক্ত গঙ্গার শাখা-প্রশাখাগুলো নানা দিকে পালতোলা নৌকায় পণ্য আর স্টিমারে মানুষ বহন করে। কয়েকটি নৌকা আনা-নেওয়া করে নদীর মাটি, এঁটেল মাটির সঙ্গে সেগুলো মিশিয়ে পাত্র তৈরি করে কুমোরেরা। এখানেও জ্বালানি কাঠের অনেক স্তূপ, তার পাশে ওজন করার দাঁড়িপাল্লা।
বিকেলে বেলাল আমাদের নিয়ে গেল জেনেভা ক্যাম্পে; একটি বিশৃঙ্খল, গাদাগাদি লোকে ঠাসা বস্তি, ২০ হাজার মুসলমান বিহারির সেখানে বাস। ১৯৪৭ সালে তারা ভারতের বিহার রাজ্য থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানে। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ের পর ভারতের সামরিক সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান যখন বাংলাদেশ হলো, তখনো আবার পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিল বিহারিরা। কিন্তু তাদের পাকিস্তানপ্রীতির প্রত্যুত্তর মেলেনি, তাদের থেকে যেতে হয়েছে এখানে। ভারতে বিহারে ফিরে যাওয়ার দরজা বন্ধ। বাংলাদেশ তাদের গণ্য করে শরণার্থী হিসেবে। তাদের ক্যাম্পে পানি সরবরাহ অপর্যাপ্ত, কাজকর্মের অনুমতি সীমিত, তাদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। অবিরাম ভাতের অভাব, তাই তাদের ৮০ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার।
পাকিস্তানি-বিহারিদের শরণার্থী হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেয়নি। জেনেভার রেডক্রস এদের সমস্যা ন্যস্ত করেছে রেডক্রসের বাংলাদেশ শাখার ওপর, তারা সেটা চাপিয়েছে ঢাকার পৌর কর্তৃপক্ষের কাঁধে। ফলে কেউ তাদের জন্য কিছু করে না। শুধু কয়েকটি খ্রিষ্টান ত্রাণ সংস্থা মাঝেমধ্যে তাদের চাল দিয়ে থাকে (অন্যান্য ইসলামি দেশগুলোর কাছ থেকে এ পর্যন্ত যা এসেছে, তা হলো রাশি রাশি প্রচারণা)।
ওখানে ছোট্ট একটি স্কুল আছে, তিন শিফটে দুই হাজার ছেলেমেয়ে তাতে পড়াশোনা করে। ছয় থেকে আটটি শিশুর পরিবার থেকে সাধারণত মাত্র একজনকে স্কুলে নেওয়া হয়। উর্দু ও বাংলার পাশাপাশি শেখানো হয় ইংরেজি। স্নাতক পরীক্ষার সময় একজন ছাত্রকে ৬০০ টাকা ফি দিতে হয়, এটা একজন শিক্ষকের এক মাসের উপার্জনের কাছাকাছি। জেনেভা ক্যাম্প এ রকম অনেকগুলো বস্তির একটি। পাকিস্তানে যেতে পারছে না এ রকম দুই লাখের বেশি বিহারি এই শিবিরগুলোতে বাস করে। কিছুদিন আগে একটি শিবিরে আগুন লেগেছিল। আগুন নেভানোর জন্য পানি ছিল না, অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এই দুঃখজনক ঘটনাটি আমি রাজনীতিকদের কাছে তুললে জবাবে তাঁরা বলেন: ট্র্যাজেডি। এরপর তাঁরা প্রসঙ্গ বদলান (জানি না বার্লিনে ফিরে গিয়ে এদের জন্য, অন্তত স্কুলটির জন্য, কিছু সাহায্যের উদ্যোগ নিতে পারব কি না)। বেলাল চৌধুরী অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বলছিলেন যে তিনিও এই বস্তি এত দিন কেবল বাইরে থেকে দেখেছেন...
ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে পড়ি গ্রামের উদ্দেশে। সকালের সজীব হাওয়ায় জমে যাওয়া শরীরগুলো কাপড়, শাল, কাঁথা-কম্বলে মোড়ানো। অধিকাংশ ঘরের চালা টিনের। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় এখানকার গ্রাম বেশি ঘন। একটি গ্রাম মিশে আছে আরেক গ্রামের সঙ্গে। আমাদের গন্তব্য টাঙ্গাইলের একটি মসলিন বাজার। মানুষের চাপে প্রদর্শনীর জন্য রাখা কাপড়ের রোলগুলো প্রায় দেখাই যায় না। কিন্তু যে মধ্যস্বত্বভোগী দালালেরা এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা ছাড়া এই বায়বীয় জাল কে আর কিনতে পারে?
এরপর আমরা পাশের গ্রাম পাথরাইলে যাই, তাঁতিদের এ গ্রামে হিন্দুদের বাস, সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। নিঃশব্দতা আর শুধু তাঁতের শব্দ। একটি শাড়ির ওপর একজন তাঁতি উবু হয়ে থাকে ১১ দিন ধরে। এই শাড়ি থেকে সে পাবে এক হাজার টাকা, প্রায় তিরিশ ডলার। দালালদের ওপর নির্ভরতার ফলে এই তাঁতিরা অচিরেই সবকিছু ছেড়েছুড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে বাধ্য হবে, কিন্তু সেখানেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ওই দালালেরাই।
গ্রামের অলিগলিতে নতুন টাকু থেকে খোলা তুলোর সুতো শিশিরবিন্দুর মতো চিকচিক করে। শাখাবহুল গাছের নিচে গরু-বাছুর। আমরা হেঁটে নদীর দিকে যাই। অনেক অনেক শিশু। ধানখেতে খেলা করছে দুটো বেজি। পাঠশালার বইয়ের স্মৃতি: রিক্কি টিক্কি-টাফি...
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনা করলে এখনকার সবকিছু বেশি সংগঠিত, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বলে মনে হয়। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরগুলোর দেয়াললিখনে (সেগুলো প্রায়ই মুছে দেওয়া)। প্রেসিডেন্ট একজন জেনারেল, যিনি আবার কবিতা লেখেন। যেনবা শঙ্কাহীন-নদী-নালার বাহুতে বিভাজিত—এই অসুখী ভূমি পড়ে আছে খোলামেলা ও উদার, লালসার থাবার কাছে উন্মুক্ত। সেনারা শাসন করে, কিন্তু ইসলামেরও তাতে জায়গা আছে, আছে পশ্চিমা পুঁজিরও।
মৌলিক খাদ্যচাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। (আমি দাউদের পরিবারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সে যদি দেশে ফিরে আসে তাহলে তার বিপদ হতে পারে কি না। একটি অনর্থক প্রশ্ন। পরে পরিবারের সদস্যদের আমাদের পাশে নিয়ে অ্যালবামের জন্য আমরা ফটো তুলি)। সংক্ষিপ্ত যাত্রা শেষে আমরা এসে পৌঁছি একটি মফস্বল শহরে। সে শহরের ইতিহাস রক্তাক্ত, তার সাক্ষ্য মিলছিল ধ্বংসস্তূপ আর পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরগুলোর দৃশ্যে। এখানেও একসময় বাস করত তাঁতিরা। তারা যে মসলিন বুনত অনেক অনেক দূরের দেশে পর্যন্ত তার কদর ছিল ভীষণ। ইংরেজদের বয়নশিল্প রক্ষা করার জন্য তাদের তুখোড় আঙুলের ডগা কেটে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে এই তাঁতিদের উত্তরসূরিদের কচুকাটা করে মুসলমানরা। যারা প্রাণে বেঁচে ছিল তারা পালিয়েছে। এখন যা অবশিষ্ট পড়ে আছে তা শান্ত-সমাহিত: প্রচুর ঘাস, লতা-পাতা, আগাছায় পূর্ণ এক দৃশ্যপটে ধ্বংসস্তূপের পাহাড়। একটি পর্যটনকেন্দ্র পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে, সেটি নির্মিত হবে জাদুঘরের পাশে।
তারপর নির্ধারিত নানা কর্মসূচি, গোলটেবিল বৈঠক, যেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্তেরা সুর মেলায়। এক ফাঁকে ঢাকার জাতীয় জাদুঘর দেখতে যাই। ভারতীয়-ইউরোপীয় আধুনিকদের আঁকা শিল্পকর্মের এক শোভাযাত্রা। কেবল জয়নুল আবেদিনের ব্রাশ ড্রয়িংগুলো মনে একটা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। ব্রিটিশ শাসনামলে ওই দুর্ভিক্ষে ২০ লাখের বেশি বাঙালি অনাহারে প্রাণ হারিয়েছিল। এখন যদি আপনি প্রশ্ন করেন, দায়ী কে ছিল? এখতিয়ার নিয়ে শুনতে পাবেন সাধারণ মতানৈক্যটি—লন্ডন দায়ী ছিল, নয়াদিল্লি দায়ী ছিল, দোষ ছিল স্থানীয় কর্তৃপক্ষের। আর পাবেন নৈরাশ্যবাদী জবাবের পুনরাবৃত্তি: পরিস্থিতি ছিল নিরুপায়, যুদ্ধাবস্থা, পরিবহনের অভাব, ভারতীয়দের মধ্যকার অন্তর্বিরোধ, মন্দ আবাদ, আবহাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। (কথা প্রসঙ্গে, সুভাষচন্দ্র বসু—তখন জাপানিদের নিরাপত্তাধীনে—এক লাখ টন বর্মি চাল প্রদানের এক ব্যর্থ প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু লন্ডন তো তার শত্রুর কাছ থেকে কিছুই নেবে না)।
হলদেটে ও লালচে খয়েরি রঙের কাগজে আঁকা জয়নুল আবেদিনের ছবিগুলোতে—সংখ্যায় সেগুলো মোট প্রায় ৩০টি—দেখা যায় ভিক্ষুক, অনাহারে মরণাপন্ন মানুষ। ব্রাশের অল্প কটি আঁচড়, বহিঃরেখা, সংযত ডিটেইল। পশ্চাৎপট প্রায়ই নেহাত ইঙ্গিত। ক্ষুধার ভঙ্গি, মুমূর্ষু ও মৃত মানুষের ওপরে কাক, ভবঘুরে কুকুর। শিশুদের ফুলে ওঠা পেট, শূন্য পাত্র, আবর্জনা। প্রায়-শুষ্ক ব্রাশের দ্রুত টানে সৃষ্ট চিত্রসংক্ষেপ।
পরবর্তী সময়ে আবেদিন ভারতীয় লোকশিল্পকে শৈলীভূত করেছিলেন, দৃষ্টির পক্ষে সহজ করেছিলেন। একটি ম্যুরাল, সেটির বিষয় ১৯৭০ সালের নভেম্বরে এক ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী সময়। সে ঘূর্ণিঝড়ে শুধু বাংলাদেশেই তিন লাখের বেশি মানুষ সাগরে নিক্ষিপ্ত হয় এবং কাদায় চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। ছবির ব্যঞ্জনা খাঁটি আলংকারিক, যদিও কিছু কিছু ডিটেইল তার প্রথম দিকের ব্রাশ ড্রয়িংগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
গাড়ি চলছে বিমানবন্দরের দিকে। অনেকগুলো সেনা ইউনিট তৎপর, কুচকাওয়াজের অনুশীলন করছে তারা। আসন্ন বিজয় দিবসের জন্য আগাম নিরাপত্তা সতর্কতা।

গ্যুন্টার গ্রাসের বাংলাদেশ-ভারত ভ্রমণপঞ্জি শো ইয়োর টাং থেকে বাংলাদেশপর্বের সম্পূর্ণ অনুবাদ।
৮ অক্টোবর ১৯৯৯–এ প্রকাশিত প্রথম আলোর ‘শুক্রবারের সাময়িকী’ থেকে পুনর্মুদ্রিত।