লেখা খাঁটি হলে তা কাল ছুঁয়ে মহাকালকে এমনিতেই স্পর্শ করবে

শামসুর রাহমান,	হাসান হাফিজুর রহমান,কাইয়ুম চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী,	বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান
শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান,কাইয়ুম চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান
মাইকেল মধুসূধন দত্তকে নিয়ে নাটক লিখতে চেয়েছিলেন, চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার আগে এই সাক্ষাৎকারে সৈয়দ শামসুল হক জানিয়েছিলেন তাঁর সে ইচ্ছার কথা। আরও বলেছিলেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে—লেখকজীবন, ঘরসংসার, বন্ধুবান্ধব, সাহিত্য—কত কিছুই না এসেছিল সেই আলাপচারিতায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পিয়াস মজিদ
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পিয়াস মজিদ: এত এত লেখা লিখেছেন আপনি। ক্লান্তি আসে না কখনো?
সৈয়দ শামসুল হক: আমি জীবনের সবকিছুকেই উদ্‌যাপন করি। একটি কাঙ্ক্ষিত লেখা শেষের পর নিজেকে নিজেই একটি লাঞ্চ বা ডিনার উপহার দিই। নিজের কাছে নিজেই তখন অনুভব করি যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হলো আমার দ্বারা।
পিয়াস: আপনার বন্ধুদের সম্বন্ধে বলুন।
সৈয়দ হক: আমার বন্ধুভাগ্য ভালো বলতে হয়। এই যে আনিসুজ্জামান—স্মৃতিশক্তি কিন্তু তাঁর মননশক্তির মতোই প্রখর। এখনো কোনো সন-তারিখ নিয়ে বিভ্রমে পড়লে ওঁর শরণ নিই। এই তো সেদিন যুবলীগের অফিস কোথায় ছিল সেটা নিশ্চিত হওয়া গেল আনিসের বরাতে। বোরহানকে (বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর) ফোন করলাম এর মধ্যে একদিন। বলল, কানাডায় ছেলের বাড়িতে বসে চুটিয়ে গল্প-কবিতা লিখছে। শুনে ভাবছিলাম, বন্ধুদের কাছ থেকেও যে প্রেরণা পাওয়া যায় সেই সত্যের কথা। তারুণ্যের প্রথম প্রভাতে বোরহানকে একেবারে অন্য রকম কবিতা লিখতে দেখেছি। চাঁদ-তারা মার্কা কবিতার যুগে নিসর্গ, মানুষ ও দর্শনের আভায় স্নাত ওঁর কবিতা জগৎ সমসাময়িক আমাকে দিশাও দিয়েছে। আর ওয়াহিদুল (ওয়াহিদুল হক) চলে গেল, গাফ্ফার (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী) বিলেতে, কাইয়ুমও (কাইয়ুম চৌধুরী) নেই। শামসুর রাহমানকেই বা ভুলি কী করে? মনে পড়ে, একবার আমার শ্বশুরালয় যশোরে গিয়েছেন শামসুর রাহমান। সবাই উৎফুল্ল কবিকে কাছে পেয়ে। একদিন মধুসূদনের সাগরদাঁড়িতে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে। স্থানীয় এক উৎসাহী সঙ্গদাতা কবিকে সাগরদাঁড়ির চারপাশটা দেখিয়ে বলতে লাগল, ‘এই যে দেখুন নদী-নিসর্গ-গাছপালা—এইসব দেখে মধুসূদন কবি ছাড়া আর কী হতে পারত বলুন?’ কী কারণে যেন শামসুর রাহমানের মুড অফ ছিল সেদিন। উৎসুক বক্তার কথায় পানি ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘এইসব দেখে তিনি মাঝিও তো হতে পারতেন।’ তো এমন পরিহাস, রসবোধ কিন্তু শহীদ কাদরীরও ছিল। ধসিয়ে দিতে পারতেন যেকোনো কিছুকে ব্যঙ্গ করে।
পিয়াস: আপনার ঘরসংসার নিয়ে কিছু জানতে চাই।
সৈয়দ হক: মঞ্জু মানে আনোয়ারার (আনোয়ারা সৈয়দ হক) সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয়-বিয়ে প্রসঙ্গে আগেও লিখেছি। এখন শুধু বলতে চাই, ওর মুখে পারিবারিক-সাংসারিক কথাবার্তার চেয়ে সাহিত্যের প্রসঙ্গই যে বেশি শোনা যায়—এটা আমার আত্মাকে আরাম দেয়। সাহিত্যই ওর প্রধান সংসার। গল্প-উপন্যাস-শিশুসাহিত্য তো লিখেছেই কত কত; ল্যু সালোমে কিংবা পিকাসো নিয়ে তার প্রবন্ধ-নিবন্ধ আমাকে অবাক করেছে। আমি জীবনের কাছে ঋণী আরও বহু কারণের মতো এই কারণে যে আনোয়ারা আমার জীবনে এসেছে। রোগ-শোকে, সম্পদে-বিপদে বিগত অর্ধশতক যেভাবে সঙ্গ দিয়ে গেছে আমাকে; আমি বড় কৃতজ্ঞ ওর কাছে। আর আমার অনেক কিছুতে মঞ্জুও হয়তো বিরক্ত হয় মাঝেমধ্যে। কোনো অনুষ্ঠানে আমি উদ্যোক্তাদের যদি অংশগ্রহণের আশ্বাস দিই, তবে ঠিক সময় সেখানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি। গিয়ে হয়তো দেখা গেল আমরা সেখানে প্রথম গিয়েছি। মঞ্জু তখন বলে, কী দরকার ছিল এত আগে আসার। কিন্তু আমি বলি, যথাসময়ে নেমন্তন্নে উপস্থিত না থাকলে নিমন্ত্রণকারীকে সম্মান দেখানো হয় না। আমার সময়ের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে এ ব্যাপারে দেখেছি অনড়।

পিয়াস: আপনার প্রিয় সম্পাদকেরা...

সৈয়দ হক: একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমানের নাছোড় তাগাদায় ইতিহাসের অংশ হয়ে রইলাম। চেয়েছিলাম গল্প লিখতে; গল্প লিখতে না পারায় একুশের কবিতা লিখিয়ে নিয়ে আমার মতো এক অল্পবয়সী ছোকরাকে একুশের ইতিহাসের অন্তর্গত করে রাখলেন সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান। পরবর্তীকালে পূর্বাণী ঈদসংখ্যায় উপন্যাস আদায় করার ব্যাপারে গোলাম সারওয়ারকেও দেখেছি নিপুণ নিষ্ঠাবান। এমনও হয়েছে আমার উপন্যাস পরদিন সকালে আদায় করতে আগের রাত থেকে আমার বাড়ির বাইরে বসিয়ে রেখেছেন তাঁর সহযোগী, কবি ইকবাল হাসানকে। আর আবুল হাসনাত কত যে ধারাবাহিক লেখা শুরু ও শেষ করিয়েছেন আমার হাত দিয়ে—সেই সংবাদ থেকে আজকের কালি ও কলম যুগ পর্যন্ত; তার ইয়ত্তা নেই কোনো। এ ছাড়া প্রথমে ভোরের কাগজ, পরে প্রথম আলোতে বিম্বিত কবিতাগুলো লিখতে প্রেরণা দিয়েছেন অনুজ কবি ও সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। এভাবে অনেক লেখা হয়তো সম্পাদকের তাগাদা না পেলে করোটির অন্ধকারেই নৃত্যরত থাকত। তারা যে আমার গর্ভজাত সন্তানের স্বীকৃতি পেল, তার পেছনে সম্পাদকদের তাগাদার ভূমিকা বিশাল।

যৌবনে সৈয়দ শামসুল হক, ১৯৬২। ছবি: কাইয়ুম চৌধুরী
যৌবনে সৈয়দ শামসুল হক, ১৯৬২। ছবি: কাইয়ুম চৌধুরী

পিয়াস: নিজের উত্তর প্রজন্ম সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সৈয়দ হক: ষাটের কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তারপর রফিক আজাদ, সিকদার আমিনুল হক। পড়ি তো প্রায় সবারই বই। বাড়িতে যেসব বই, লিটল ম্যাগাজিন আসে কখনো তার মধ্যে অচেনা কোনো তরুণ-তরুণীর একটি পঙ্‌ক্তির দ্যুতি দেখে চমকে উঠি। কারও বিশুদ্ধ ছন্দ-কাজ কিংবা কারও কাঠামো নির্মাণের সচ্ছলতায় বিস্ময় মানি।
পিয়াস: কয়েকজন মানুষের সোনালী যৌবন, প্রেমের গর্ভের জলে নয় মাস, ভূমিষ্ঠ হয়েছি, বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল—এমন অনেক বইয়ের কী বিচিত্র নাম দিয়েছেন আপনি। এত অনন্য নামের উৎসমুখ কোথায়?
সৈয়দ হক: রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, নাম হচ্ছে লাউয়ের বোঁটার মতো। ধরতে সুবিধা হয়। তো এ বিষয়ে খুব একটা ভাবি না আমি। আনিস চৌধুরীর একটি উপন্যাসের নাম ভাঙা ভাঙা দিন; সেই কবেকার লেখা কিন্তু নাম শুনে মনে হয় এ তো এখনকার তরুণ কোনো কবির নবজাত বইয়ের নামও হতে পারত। পরিপার্শ্বে লক্ষ করি হাসনাত আবদুল হাই যেমন এক শব্দে বইয়ের নাম দেন প্রায়ই—নভেরা, সুলতান, তিমি ইত্যাদি। তেমনি শামসুর রাহমানকে দেখেছি প্রতিটি বইয়ের নামেই কবিতার ব্যঞ্জনা বজায় রাখতে। এই যেমন তাঁর বইয়ের নাম এক ধরনের অহংকার। একটা ঘোষণা আবার কী ভীষণ কবিতা—ওই এক লাইনেই কিন্তু পুরো বিষয়টা ধরা আছে।
পিয়াস: কখনো কি এমন হয় আপনার—নিজের লেখা গল্প-উপন্যাস-নাটকের চরিত্ররা তাড়া করে ফেরে বা সঙ্গ দেয় আপনাকে?
সৈয়দ হক: একেবারে বাস্তবিক উদাহরণ হলো এই যে আমার নাটক নূরলদীনের সারাজীবন লেখা ও মঞ্চায়নের পর একদিন বাড়িতে দেখি নূরলদীনের বংশধর দাবিদার এক নারী এসে হাজির। সরকারের কাছে বলে নূরলদীনের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ তার। আমি তাকে বলি যে আমি নাটক লিখেছি মাত্র, বাস্তবিক নূরলদীনের বংশধরের সত্যাসত্য যাচাই আমার কাজ না। আর নিজের লেখার চরিত্রের সংসর্গ যদি বলি তো শুধু গল্প-উপন্যাস কেন আমি যে সিভি কাবাফির কবিতা অনুবাদ করেছি সে কাবাফির জীবনটাও অনুবাদসূত্রে আমার ভাবনায় ক্রীড়া করে। একজন একলা কবি অন্ধকার নিঃসঙ্গ ঘরে সিঁড়ি ভেঙে উঠছেন, সঙ্গে সঙ্গে উঠছেন তাঁর শব্দ ও বোধি—জনারণ্যে নিজেকেও এমনভাবে উপলব্ধি করে উঠি কখনো সখনো।

পিয়াস: অগ্রজদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কথা যদি বলতেন...

সৈয়দ হক: এই যে একত্রিশ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছি সব মান্য অগ্রজদের সঙ্গে, তার জন্য বিচারক কমিটির সদস্য মুনীর চৌধুরীর অবদান অনেক। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, সিকান্‌দার আবু জাফরের মতো প্রাজ্ঞ প্রবীণদের সামনে পেয়েছি। মনে আছে সরদার ফজলুল করিম বাংলা একাডেমিতে থাকতে আফ্রিকার কবিতা নিয়ে আমাকে লিখতে, অনুবাদ করতে বাধ্য করেছেন। আবুল হোসেন তাঁর সংলাপ পত্রিকায় আমাকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কারগো’ গল্প। অনুবাদটি নিশ্চয়ই ওয়ালীউল্লাহ পছন্দ করেছেন। তাই তাঁর গল্পের বইয়ে আমার অনুবাদটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন আমারই দেওয়া ‘কেরায়া’ শিরোনামে। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বা কবীর চৌধুরীর স্নেহছায়ায় এখনো যেন সিক্ত আমি, দাঁড়িয়ে রয়েছি বাংলার এই পবিত্র মাটিতে।

পিয়াস: আপনার লেখায় নানাভাবে এসেছে রাজনীতির প্রসঙ্গ। রাজনীতিকে কীভাবে দেখেন?

সৈয়দ হক: রাজনীতি তো সাহিত্য থেকে আলাদা কিছু নয়। আমাদের আনন্দিত বা বিষণ্ন বিধিলিপির নাম রাজনীতি। প্রাঙ্গণে মোর নাট্যদল যে ‘সৈয়দ হক নাট্যোৎসব’ আয়োজন করল, তার মাধ্যমে লিখে ওঠার দীর্ঘদিন পর ধারাবাহিকভাবে নাটকগুলো দেখে নিজেই নিজের দূরত্বে থেকে আবিষ্কার করলাম, কী আশ্চর্য! আমার প্রায় প্রত্যেকটি নাটকেই এসেছে দেশ, মানুষ, সমাজ ও মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসিতে যে কাজ করেছি, সেখানে পেশাগতভাবে বাংলাদেশের একটা সংবাদ অন্য দেশের মানুষের কাছে শুধু সংবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে আর আমাদের বাঙালি কর্মীদের কাছে সেটা ছিল জীবন-মরণ ব্যাপার। গত শতকের উনিশ শ বিরানব্বইতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণ-আদালতে অভিযোগ দাখিল করেছি আমরা তিন বন্ধু—আনিস, বোরহান ও আমি। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগটি উত্থাপন করি আমি। আজ সেই গণহত্যার দায়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে এই বাংলাদেশে। ভাবতে ভালো লাগছে এই কারণে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার প্রারম্ভপর্বে যুক্ত ছিলাম আমরা—পঞ্চাশের সন্তানেরা; এক অর্থে ভাষা আন্দোলনের মোহনা বেয়ে যারা বেড়ে উঠেছি।

পিয়াস: সমালোচনাকে কীভাবে গ্রহণ করেন আপনি?

সৈয়দ হক: সমালোচনা হচ্ছে যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আলোচনা। আর নতুন যা হওয়ার অপেক্ষা তা হচ্ছে সৃষ্টি। আমার সমস্ত আগ্রহ সেই সৃষ্টিকে ঘিরে। তাই আমার সাহিত্যকর্ম নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক কোনো আলোচনায় আমার খুব একটা আগ্রহ নেই।যদিও নিন্দামন্দের সমান্তরালে সাহিত্যজীবনের প্রথম প্রভাতেই পেয়েছি রশীদ করীমের মতো অগ্রজ লেখকের মূল্যায়ন। তিনি অনতিতরুণ আমাকে নিয়ে লিখেছেন মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদকীয় পাতায়। একজন লেখক সেদিন বলল, আপনার সমস্ত বইয়ের প্রথম সংস্করণ একসঙ্গে গুছিয়ে রাখা দরকার। আমি বললাম, কী দরকার? হয়তো কয়েক শ বইয়ের ভিড়ে ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’ কথাটা শুধু টিকে থাকবে। কিংবা হয়তো তা-ও থাকবে না। মানুষের পাঠে থাকছি কি না, বোধিতে থাকছি কি না, তা-ই মুখ্য। এসব সংরক্ষণশীলতায় কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না সাহিত্যের। ফলে দেখবে আমার উপন্যাস-গল্প-কবিতা-নাটকের সংকলনের তথ্যসূত্র হিসেবে কোনো সনতারিখের ধারাবাহিকতা থাকে না। লেখা খাঁটি হলে তা কাল ছুঁয়ে মহাকালকে এমনিতেই স্পর্শ করবে।

পিয়াস: কথাসাহিত্যের বিষয় হিসেবে আপনার আরাধ্য কী?

সৈয়দ হক: মনোলোকের কাজটিকেই কথাসাহিত্যে প্রধান বলে মানি। কিন্তু একালে বিষয়ের হুল্লোড়ে মনোকেন্দ্রিকতা কি হারিয়ে যাচ্ছে না? তলস্তয়ের দিকে তাকালে দেখব কত বড় বড় উপন্যাস লিখেছেন একজন মানুষের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে করতেই।

পিয়াস: সম্প্রতি আপনি কী পড়ছেন?

সৈয়দ হক: প্রমথনাথ বিশীর লাল কেল্লা। মধুসূদনের চিঠিপত্রের সংকলন। কখনোবা বাংলা একাডেমির লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা কিংবা প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ উল্টেপাল্টে দেখি। কখনো অনুবাদের জন্য শেক্‌সপিয়ারের হ্যামলেট অথবা রোগশয্যায় প্রবোধকুমার সান্যালের কোনো বই, কখনো হয়তো পবিত্র কোরআন শরিফ অথবা মহাভারত। কোরআনের অংশবিশেষ অনুবাদও করেছি আমি; কবিতামতো কিছু আয়াত। যথেষ্টসংখ্যক নয় বলে প্রকাশ করিনি।

পিয়াস: লেখালেখি, শিল্পচর্চা নিয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা কি আছে আপনার?

সৈয়দ হক: মাইকেল মধুসূদনকে নিয়ে একটি নাটক লেখার ইচ্ছা আছে। গদ্যকবিতার একটি সংগ্রহ বের হওয়ার কথা। দেশভাগ নিয়ে লেখা নদী কারো নয় উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে অনেক দিন; সেটি শেষ করে আনব। ‘হে বৃদ্ধ সময়’ নামের আত্মজৈবনিক রচনার শেষ পর্ব শিগগিরই প্রকাশের ইচ্ছা রাখি। আশি বছর পেরোলে আমার আঁকা ছবির একটি প্রদর্শনী আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে এখনই তা সম্ভব হচ্ছে না। আমার নির্মিত ভূখণ্ড জলেশ্বরীর একটি কল্পিত মানচিত্র আঁকতে চাই, যা পাঠক সমাবেশ থেকে কয়েক খণ্ডে প্রকাশিতব্য জলেশ্বরী সংকলনে স্থান পাবে।

পিয়াস: আপনি তো একসময় প্রকাশক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সে সম্পর্কে বলুন।

সৈয়দ হক: হ্যাঁ, ‘সব্যসাচী’ নামে আমার পারিবারিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল ছোট আকারে। যদিও এই ছোট প্রকাশনা সংস্থা থেকেই বেরিয়েছে শামসুর রাহমানের ইলেকট্রার গান, রফিক আজাদের প্রিয় শাড়িগুলি-এর মতো মহার্ঘ্য বই।

পিয়াস: আপনার বিবেচনায় ভাষা কীভাবে ধরা দেয়?

সৈয়দ হক: ভাষা হচ্ছে লেখকের নির্বাচন করা ব্যবহার্য রঙের মতো। এই রঙের ছাপই একজন লেখকের যেকোনো লেখাকে আলাদা করে চেনাবে।

 পিয়াস: শিল্পের নিজস্ব শৈলী সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

সৈয়দ হক: আমি মনে করি কবিতাসহ যেকোনো শিল্পকে তার নিজস্ব মাটিবর্তী অবশ্যই হতে হবে। এ জন্য আমি ওরহান পামুকের চেয়ে তুর্কি শৈলীর নিজস্বতার ব্যবহারের কারণে ইয়াসের কামালের কথাকাহিনিতে আকর্ষণ বোধ করি বেশি। আর আমাদের বাংলা অঞ্চলে একসময়ে কবিতা সুর করে জনজমায়েতে গীত হতো বলে আমি কবিতার শ্রুতিকে খুব মূল্য দিই। বিভিন্ন জায়গায় পাঠ করি নিজের কবিতা। এর মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে কবির সংযোগ আরও নিবিড় হয়যেমন, তেমনি বাংলার কবিতা পাঠের হারানো রেওয়াজ ফিরে আসার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।

পিয়াস: এক জীবন উদ্‌যাপন করলেন লেখার সাধনায়। জীবনের এই প্রান্তে এসে এ বিষয়ে আপনার উপলব্ধি কী?

সৈয়দ হক: হিন্দি ফিল্মের কাহিনিকার শ্রী রামচন্দ্র বলেছিলেন, ‘নিজের ভালো লেখার পুনরাবৃত্তি কেবলই ব্যর্থ লেখার জন্ম দেয়।’ আমি এখনো একটি নতুন লেখার সময় এ বিষয়ে সচেতন থাকার চেষ্টা করি, যেন পুনরাবৃত্তিতে আটকে না থাকি।