এবারও দারুণ বাজি

আর কয়েক দিনের মধ্যেই ঘোষিত হবে সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখকের নাম। এবার কোন কোন লেখক এগিয়ে আছেন নোবেল দৌড়ে? কে পাবেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার?
.
.

কে পাবেন ২০১৬ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার? বাজিকরদের সম্ভাব্য তালিকা দীর্ঘ। বোদ্ধাদের বিশ্লেষণ নেড়েচেড়ে দেখলে অনেকের নাম ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই ঘোষণা করা হবে বিজয়ীর নাম। তবুও নোবেলের ভূগোল নির্ধারণে এবারও বসেছে দারুণ বাজির আসর। দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা হাফিংটন পোস্ট-এর মতো খ্যাতনামা পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতায় ২০১৬ সালের সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীদের নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে হরেক রকমের লেখা। সেসব লেখায় বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের পাশাপাশি একেবারেই অজানা-অখ্যাত কিন্তু লেখক হিসেবে বড়—এমন অনেকেরই নামই আছে।
আবার অনলাইনভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল লেডব্রুকস বাজিকরদের ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর নির্ভর করে সম্ভাব্য বিজয়ীদের একটি অতি দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করেছে। আমার এই লেখার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে ওই তালিকাটি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তবে কোন লেখকের ভাগ্যে ঠিক কী কারণে এ বছরের নোবেল জুটবে—তা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো এই নিবন্ধের বিশ্লেষণমূলক আলোচনার পাটাতন হিসেবে কাজ করেছে।
এবার প্রতি পাঁচজনে একজন বাজি ধরেছেন জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হারুকি মুরাকামির জন্য। বাজিকরদের তালিকায় সর্বাগ্রে মুরাকামির নাম। কারণ হিসেবে প্রথমেই বলা যেতে পারে, তাঁর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসই অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। তাঁর লেখায় জাপানের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। তা ছাড়া তাঁর ঝুলিতে আছে ফ্রান্‌জ কাফকা পুরস্কারসহ অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। আমার এক অগ্রজ মুরাকামির উপন্যাস কাফকা অন দ্য শোর পড়ে বলেছিলেন, এই একটি উপন্যাসের জন্যই তাঁকে নোবেল দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু গত কয়েক বছরের ধারা দেখলে মনে হয়, নোবেল কমিটি পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে যাঁরা একটু কম পরিচিত বা কম পাঠকপ্রিয়, তাঁদেরই তুলনামূলকভাবে বেশি বিবেচনায় নিয়ে থাকে। তবে কি মুরাকমির আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে? সময়ই দেবে উত্তর।

মুরাকামির চেয়েও সাহিত্য বোদ্ধারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন কেনিয়ার ঔপন্যাসিক ন্‌গুগি ওয়া থিয়োঙ্গাকে। প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস নোবেল পুরস্কারের জন্য ন্‌গুগিকে সবচেয়ে ‘যোগ্য ও নির্ভেজাল প্রার্থী’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের মতে, আফ্রিকা মহাদেশে জে এম কোয়েটজির পর নোবেল পুরস্কারের জন্য সব রকম যোগ্যতা রাখেন ন্‌গুগিই।

নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হবে, সিরিয়ার কবি আদোনিসের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার মাধ্যমে নোবেল কমিটি এবার সহজেই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারে। সিরিয়ায় আভা-গার্দ আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। তাঁর হাতে নতুন মাত্রা পেয়েছে আরব কবিতা। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অধুনা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ তিনি। তা ছাড়া বহু বছর ধরে ইউরোপে থাকার ফলে সমসাময়িক সিরিয়াকে বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে তাঁর—পাঠকদের এমন একটি অভিযোগ আছে আদোনিসের বিরুদ্ধে। এই কবি স্বৈরশাসক আসাদকে চিঠি পাঠিয়েছেন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে। তবে আসাদবিরোধী বিদ্রোহী ও অভিবাসীদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেননি। কিন্তু এই সবকিছু ছাপিয়ে অসামান্য সাহিত্যকর্মের জন্য আদোনিস এবার নিঃসন্দেহে হতে পারেন বিচারকদের সেরা পছন্দ।

যদিও প্রতি সতেরো জনে একজন জয়েস ক্যারল উটসের পক্ষ নিয়েছে, কিন্তু আমাদের মনে হয়, আমেরিকার সাহিত্যে তাঁর অবদান যৎসামান্য, তাই উটসের চেয়ে বরং বাজিকর ও বোদ্ধা—এ দুই পক্ষের দৃষ্টিতেই এগিয়ে আছেন আলবেনীয় ঔপন্যাসিক ও কবি ইসমাইল কাদারে। আমাদের মনে পড়ে, কাদারের বই দ্য ফাইল অন এইচ-এর কথা। গল্প বলার যে শত বছরের ঐতিহ্য আছে তা তিনি তাঁর সাহিত্যে প্রতিস্থাপিত করেছেন। তা ছাড়া কাদারে যে ভূগোল নিয়ে লেখেন তা মানুষের খুব একটা নজরে আসে না। অজানা ওই ভূগোলের গল্পকে সামনে তুলে ধরতে নোবেল কমিটি বিবেচনায় নিতে পারে কাদারের সাহিত্যকে।

বাজিকরেরা যতই বলুক, কোনো আমেরিকান ২০১৬-এর সাহিত্য নোবেল পুরস্কার পাবেন না, আমাদের তা বিশ্বাস হয় না। কেননা ফিলিপ রথের মতো সাহিত্যিক অনেকগুলো যৌক্তিক কারণেই এবারের নোবেল জিততে পারেন। প্রথমত, সমসাময়িক আমেরিকার বিকারগ্রস্ত সমাজের বাস্তবচিত্র তিনি তুলে ধরেছেন নিজের লেখায়। এ ছাড়া কয়েকটি উপন্যাসে দেখানোর চেষ্টা করেছেন ঘুণে ধরা সমাজ বদলে যুবসমাজের অগ্রণী ভূমিকাকে; এবং সমকালীন রাজনৈতিক সচেতনতা তাঁর ফিকশনকে করে তুলেছে ব্যতিক্রমী। ফলে রথের মতো সাহিত্যিকের গলায় অনায়াসেই এবার ঝুলতে পারে নোবেল। তবে রথের সঙ্গে সঙ্গে স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক ও কলামিস্ট জেভিয়ার মেরিয়াসের পাল্লাও সমানভাবে ভারী। তাঁর দুটি উপন্যাস এযাবৎ অনূদিত হয়েছে ৪২টি ভাষায়। তাই সহজেই বোঝা যাচ্ছে মেরিয়াসের ফিকশনের গুরুত্ব। ফলে নোবেল কমিটি ইচ্ছে করলেই মেরিয়াসকে এড়িয়ে যেতে পারবে না।

পাঠক, হেরটা ম্যুলারের কথা আপনাদের হয়তো মনে আছে। অস্ট্রিয়ার এই লেখিকা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বছর কয়েক আগে। ইতিমধ্যে ওই দেশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন আরেক লেখক—পিটার হ্যান্ডকে। এখন পর্যন্ত জার্মানির প্রায় সব নামকরা পুরস্কার জমা হয়েছে তাঁর ঝুলিতে। এবার নোবেলের দৌড়েও এগিয়ে তিনি। বিচারকদের সুদৃষ্টি কি তাঁর ওপর পড়বে?

বাজির দৌড়ে আরও এগিয়ে আছেন নরওয়ের নাট্যকার ও লেখক জন ফসেও। প্রতি ২০ জনে একজন বাজি ধরেছে তাঁকে নিয়ে। গত বছরও তিনি ছিলেন বাজিকরদের তালিকায়। আইরিশ ঔপন্যাসিক জন ব্যানভাইলকেও ফসের পাশে অনায়াসে দাঁড় করানো যায়। আমাদের ধারণা, দুজনেরই পঞ্চাশ ভাগ করে সুযোগ রয়েছে পুরস্কার জেতার। সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রোমারের পর কোনো কবিকে সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হয়নি। এ বিবেচনায় কোরিয়ার বিখ্যাত কবি কো আন আছেন এগিয়ে। তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সংকলন দ্য থ্রি ওয়ে টেভার্ন-এর ইংরেজি অনুবাদ সমাদৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। বৌদ্ধ দর্শন ও প্রাচীন ঐতিহ্য তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য। একজন শিকড় সন্ধানী কবিকে পুরস্কারের জন্য বিবেচনায় নিতেই পারে নোবেল কমিটি। কো আনের পাশাপাশি একই কাতারে আছেন পোল্যান্ডের কবি অ্যাডাম জাগাজিউস্কি। তবে এ প্রশ্নও অমূলক নয় যে পোল্যান্ডের এই কবির ভাগ্যে নোবেল জুটলে আদোনিরে প্রতি অন্যায় হবে না তো?

ইংরেজ সাহিত্যিক জেরাল্ড মারনামের নাম অনেককেই বলতে শুনেছি। সন্দেহ নেই, লেখার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষাকে অন্য মহিমা দিয়েছেন তিনি। তাঁর বেশির ভাগ লেখাতেই নিজের জীবনের ছাপ আছে। শৈশবকাল তাঁর লেখার একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। তবে অতিমাত্রায় আত্মজীবনীমূলক লেখায় অভ্যস্ত এমন লেখককে পুরস্কারের জন্য বিচারকমণ্ডলী বিবেচনায় নেবেন কি না, তা দেখার বিষয়। বাজিকরেরা জেরাল্ড মারনাম ও হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাজলা ক্রাসনাহোরকাইকে এক পাল্লায় মাপলেও আমরা ক্রাসনাহোরকাইকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিতে চাই। বছর কয়েক ধরে এই লেখকের নাম নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার আগে আগে শোনা যায়। এর একটি কারণ হয়তো এমন: ফিকশনে তিনি অত্যন্ত সাবলীল; লেখায় চমৎকারভাবে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের। তা ছাড়া প্রাচ্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর ফিকশনকে দিয়েছে অন্য রকম মাত্রা। তাঁর লেখায় সভ্যতার সমস্যা, পৃথিবীব্যাপী নির্যাতনের চিত্র ও ফ্যাসিবাদী সমাজব্যবস্থার নানা দিক ফুটে উঠেছে। এককথায়, তিনি সমকালীন বিশ্বে একজন প্রতিবাদী লেখক। তাই ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রতি বাজিকরদের পাশাপাশি আস্থা আছে আমাদেরও।

আবার সব জল্পনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে যদি করম্যাক ম্যাকার্থি, ডন ডেলিল্লো কিংবা কার্ল উভ নাউসগার্ড নোবেল জিতে নেন, তবে আশা করি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ ম্যাকার্থি, ডেলিল্লো কিংবা নাউসগার্ড লেখক হিসেবে আদোনিস, মুরাকামি বা নুগুগির সমগোত্রীয়। তবে আমাদের নাতিদীর্ঘ তালিকায় কিছু লেখক আছেন, যাঁরা বাজিকরদের কাছে নগণ্য হলেও আমাদের বিবেচনায় নানা কারণেই জরুরি। যেমন, কোনোভাবেই বাদ দিতে পারছি না ক্রোয়েশিয়ার ঔপন্যাসিক ডোবরাভকো উগ্রেসিক, ম্যাক্সিকান ঔপন্যাসিক সারজিও পিটোল, ফ্রান্সের লেখক মাইকেল টোরনিয়ার, অস্ট্রেলিয়ার ঔপন্যাসিক ডেভিড ম্যালউফ, ইংরেজ ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হিলারি ম্যানটেল, কানাডিয়ান কবি অ্যানি কারসন, স্কটিশ ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার জেমস ক্যালম্যান, ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জন লে কার, রোমানীয় প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক মিরসিয়া কারতারেস্কো এবং ফ্রান্সেসকো বেনেজ্জোর নাম। পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় ইসরায়েলের ঔপন্যাসিক আ. ডব. ইয়েহোশোয়া কিংবা আমেরিকার প্রখ্যাত লেখক থমাস পিনচন, লিডিয়া ডেভিস, বব ডিলান কিংবা টম স্টোপার্ডের মতো সাহিত্যিকদেরও। এ ছাড়া ইসরায়েলের বিখ্যাত ঔপস্যাসিক অ্যামস্ উজের কথা তো ভাবতেই পারে নোবেল কমিটি। এমনকি বোদ্ধা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ জোরেশোরেই উচ্চারণ করছেন আর্জেন্টাইন লেখক সিজার এইরা, পর্তুগিজ ঔপন্যাসিক অ্যান্তোনিও লোভো আনটিউনস, স্প্যানিশ সাহিত্যিক জোয়ান মারসে ও হাঙ্গেরির সাহিত্যিক পিটার নাদাসের নাম। শুনলে অবাক হবেন ইতিমধ্যে অ্যান্তোনিও লোভো আনটিউনসে‌র উইকিপিডিয়াতে লেখা হয়ে গেছে, এ বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দৌড়ে আছেন তিনি।

বাজিকরদের ঘোরপ্যাঁচে লেখকেরা নাস্তানাবুদ। আবার যদি শেষমেশ এমন হয়—আমেরিকান লেখক জন অ্যাশবেরি—যাঁর জন্য এক শ জনে মাত্র একজন বাজি ধরেছেন—তাঁর ঘরে যদি চলে যায় পুরস্কার, তখন এ কথা দ্বিধাহীনভাবেই উচ্চারণ করতে হবে, অ্যাশবেরির ভাগ্য খুললে অন্যায় হবে আদোনিসের প্রতি, অন্যায় হবে ন্‌গুগির প্রতি, সর্বোপরি অন্যায় হবে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় লেখকদের একজন মিলান কুন্ডেরার প্রতি। আমরা কি তবে বলতে চাচ্ছি, এবারের পুরস্কার মিলান কুন্ডেরার হাতে উঠবে! যদি ওঠে, তবে উপর্যুক্ত কোনো সাহিত্যিকেরই বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকবে না বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।