অজ্ঞান পার্টির খপ্পর থেকে হাসপাতালের চক্করে

কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী পর্যন্ত পুরো সড়ক যানজটে থেমে আছে। গতকাল বুধবার বেলা ১১টা। বিআরটিসির আর্টিকুলেটেড (জোড়া লাগানো) বাসটি কল্যাণপুর থেকে মহাখালী-গাজীপুর পথের যাত্রী তুলছে। কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে বাসটি ইবনে সিনা হাসপাতালের কাছে আসতেই ছয়-সাতজন যাত্রী তাড়াহুড়ো করে নেমে গেলেন। বাস শ্যামলী পৌঁছাতেই দেখা গেল, পাশাপাশি বসা দুজন যাত্রী তাঁদের আসনে অজ্ঞান হয়ে আছেন।
অন্য যাত্রীরা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সবার মনেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। সাহায্য করতে গিয়ে আবার কোন ঝামেলায় পড়তে হয়। তবু মানবিকতার দায় এড়াতে না পেরে কয়েকজন বাসের চালকের সহকারীকে ডেকে অজ্ঞান দুই যাত্রীর চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলেন। তাতে একজনের কিছুটা হুঁশ ফিরলেও অবস্থা কথাবার্তা বলার মতো নয়। অন্যজনের পানির ছিটায় কাজ হলো না। এই প্রতিবেদকও ছিলেন ওই বাসে।
বাস ততক্ষণে আগারগাঁও-মহাখালী সংযোগ সড়কে চলে এসেছে। যাত্রীদেরই কয়েকজন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সাহায্যে এগিয়ে এলেন। অজ্ঞান হওয়া একজনের পকেট হাতড়ে তাঁর মুঠোফোনটি পাওয়া গেল। মুঠোফোনে থাকা একটি নম্বরে ফোন দিলে তাঁর স্ত্রী ফোন ধরেন। জানা যায়, অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে। দুজনের শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে আত্মীয়দের দ্রুত মহাখালী আসতে বলা হয়।
দেখা যায়, অজ্ঞান হওয়া যাত্রীদের একজনের প্যান্টের সামনের অংশ কেটে ফেলেছে অজ্ঞান পার্টির লোকজন। অন্যান্য যাত্রীর উপস্থিতিতে বাসের চালকের সহকারী ওই ব্যক্তির অন্য পকেট হাতড়ে ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করেন। বাস জাহাঙ্গীর গেট পেরোতেই দুই যাত্রীর মুখ দিয়ে লালা ঝরতে শুরু করে।
বাসের চালকের সহকারী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘লোক দুইটা গাবতলী থিকা উঠছিল। মহাখালী যাইব বইল্যা ভাড়াও দিছে। কয়েকটা লোক এদেরকে ঘিরা রাখছিল। ওই লোকগুলা বাস থিকা নাইম্যা যাইতেই দেখি অজ্ঞান হইয়া আছে।’
অজ্ঞান হওয়া দুই ব্যক্তির সঙ্গে থাকা কাগজপত্র থেকে জানা যায়, একজনের নাম মো. মঞ্জুরুল ইসলাম এবং অপরজন মো. সুজন। দুজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকায় যাত্রীরা মহাখালীর কোনো হাসপাতালে তাঁদের নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বেশির ভাগ যাত্রীই তাঁদের কাজের তাগিদে নেমে যান। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এগিয়ে আসেন নাজমা আকতার নামের এক মধ্যবয়সী নারী ও মো. রুবেল নামের এক তরুণ।
মহাখালী থেকে মিরপুর ১ নম্বর পথে চলাচলকারী একটি খালি লেগুনায় ধরাধরি করে তোলা হয় মঞ্জুরুল ও সুজনকে। মহাখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে তাঁরা চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে উপদেশ দেন। দূরত্ব কম হওয়ায় এবং ফোনে আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে লেগুনা ঘুরিয়ে ওই দুজনকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
হাসপাতালের চক্কর: বেলা একটার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয় অজ্ঞান হওয়া দুজনকে। চিকিৎসা শুরুর জন্য ১০ টাকার নির্ধারিত টিকিট কেটে দেওয়া হয় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের। তাঁদের একজন অজ্ঞান হওয়া এক ব্যক্তির রক্তচাপ মেপে বলেন, ‘প্রেশার কমে গেছে। দুজনকেই ভর্তি করাতে হবে।’
কর্তব্যরত চিকিৎসক কোথায় জানতে চাইলে একজন নারী প্রথমে নিজেকে কর্তব্যরত চিকিৎসক বলে পরিচয় দেন। অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তিদের কেন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না, জানতে চাইলে তিনি চুপ করে থাকেন। পরে বলেন, তিনি কর্তব্যরত চিকিৎসক নন। কর্তব্যরত চিকিৎসক অন্য কক্ষে আছেন।
ওই কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, কর্তব্যরত নারী চিকিৎসক একটি শয্যায় বসে মুঠোফোন টিপছেন আর সামনের চেয়ারে তাঁর অল্প বয়সী ছেলে বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। কক্ষে উপস্থিত তিন-চারজন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি চিকিৎসকের ছেলেকে প্যাড, কলম উপহার দিতে ব্যস্ত।
চিকিৎসককে অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর কিছু করার নেই। তখন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চিকিৎসকের নাম জানতে চাইলে তিনি নাম বলতে অস্বীকৃতি জানান। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাড়াহুড়ো করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। চিকিৎসক শয্যা ছেড়ে বাইরে এসে তাঁর ছেলেকে ভেতরে রেখেই কক্ষে তালা দিয়ে দ্রুত জরুরি বিভাগের রিসাসিটেশন কক্ষে (জ্ঞান ফেরানোর কক্ষে) প্রবেশ করেন। একজন আয়া বলেন, ওই চিকিৎসকের নাম রীতা। পুরো নাম জানেন না।
এর মধ্যে রোগী ভর্তির ফরম পূরণ করে আনা হলে মেডিসিন বিভাগের ৫ নম্বর ইউনিটে ভর্তির সুপারিশ করা হয়। ট্রলিতে করে নিচতলার ৫ নম্বর ইউনিটে অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তিদের নেওয়া হলে কর্তব্যরত নার্স বলেন, বেড খালি নেই। আরও পাঁচ-ছয়জন বেডের জন্য সিরিয়ালে আছেন। ততক্ষণে অজ্ঞান হওয়া দুই ব্যক্তির মুখ থেকে আরও বেশি লালা ঝরতে শুরু করেছে।
নার্সের কাছে মেডিসিন ইউনিটের চিকিৎসক কোথায় জানতে চাইলে তিনি চুপ করে থাকেন। দোতলায় হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়ার কক্ষে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বিস্তারিত বললে তিনি ওই ইউনিটের চিকিৎসককে ফোন দিয়ে নিচতলায় যেতে বলেন। উত্তম বড়ুয়া বলেন, ‘চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। অজ্ঞান পার্টির রোগীদের স্যালাইন দেওয়া হলে ঠিক হয়ে যাবে। স্যালাইন না দেওয়া হলেও সমস্যা নেই, ঘুম থেকে জাগলে ঠিক হয়ে যাবে।’
পরিচালকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিচতলায় গিয়ে দেখা যায়, অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তিদের দুজনকে দুই কোনায় মেঝেতে শোয়ানো হয়েছে। একজন চিকিৎসক এসে অজ্ঞান হওয়া একজনের রক্তচাপ আবার মাপেন এবং রক্তের কয়েকটি পরীক্ষা করাতে বলেন। অন্য ব্যক্তিকে ভর্তি দেখানোর কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় চিকিৎসক তাঁকে না দেখেই চলে যান। চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় অজ্ঞান হওয়া দুজন পড়ে থাকেন। তখন ঘড়ির কাঁটা বেলা দুইটা পেরিয়েছে।
এই সময় হাসপাতালে আসেন অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন। মঞ্জুরুলের ভাই মো. ইদ্রিস আলী বলেন, মঞ্জুরুল বিদেশে লোক পাঠান। একই এলাকার সুজন বিদেশে যাবেন। তাই সুজনকে নিয়ে বনানীতে একটি রিক্রুটিং এজেন্সিতে যাচ্ছিলেন।
অজ্ঞান হওয়া দুজনের কাছ থেকে পাওয়া ৪০ হাজার টাকা, কাগজপত্র, মানিব্যাগ ও মুঠোফোন পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে পরিবারের লোকেরা মঞ্জুরুল ও সুজনকে সাভারে নিয়ে সেখানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান।