সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি হারাতে পারে?

.
.

আগামী বছরের ২০ মার্চ সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার ২০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু ওই বছরই বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মানের তালিকা থেকে সুন্দরবনের নাম বাদ যেতে পারে। নাম লেখাতে পারে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায়। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র সুন্দরবনের ব্যাপারে সর্বশেষ যে অবস্থান জানিয়েছে, তাতে এসব কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ যদি সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মানকে ধরে রাখতে চায়, তাহলে ইউনেসকো বাংলাদেশকে তিনটি উদ্যোগ নিতে বলেছে। ১. রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবন থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। ২. গঙ্গা চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে গেছে। ফলে ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। ৩. সুন্দরবন ঘিরে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ যেসব শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে, সে সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হবে।

এ কাজগুলো সরকার কতটুকু করতে পারল, তার একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন আগামী ১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও ঐতিহ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেসকোর কাছে জমা দিতে হবে। এক পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপসহ সরকারকে এই অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইউনেসকো বলেছে, এরপর ২০১৭-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রাখা হবে কি না।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের নাম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বিপন্ন ঐতিহ্যের তালিকায় চলে গেলে তা শুধু বর্তমান সরকারের জন্যই নয়, বাংলাদেশের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই সরকারের উচিত হবে আর দ্বিধা না করে দ্রুত রামপাল প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনেসকো আমাদের যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, আমরা তার জবাব দিয়েছি। আশা করেছিলাম, তারা তাদের প্রতিবেদনের পাশাপাশি আমাদের জবাবটাও প্রকাশ করবে। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম, তারা আমাদের জবাব থেকে কিছু তথ্য নিয়ে তাদের প্রতিবেদনটি সংশোধন করে প্রকাশ করেছে। তবে আমরা আমাদের কাজ অব্যাহত রাখব। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ বন্ধ থাকবে না।’

ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সুন্দরবনে, বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত স্থান থেকে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার দূরে প্রস্তাবিত রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রকে বড় ধরনের হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এই ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ প্রকল্পটির নির্মাণ বিশ্ব ঐতিহ্যের জন্য চারটি হুমকির কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। চার হুমকি হচ্ছে, কয়লার ছাইয়ের কারণে বায়ুদূষণ, বর্জ্য হিসেবে অবমুক্ত ছাই ও পানি থেকে দূষণ, ড্রেজিং ও জাহাজ চলাচল বৃদ্ধিজনিত হুমকি এবং শিল্পকারখানা স্থাপন ও এ-সংক্রান্ত অবকাঠামো তৈরির কারণে সৃষ্ট সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব।

>ইউনেসকোর ৩ সুপারিশ : ১. রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে ২. ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে ৩. সুন্দরবন ঘিরে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা সম্পর্কে সমন্বিত সমীক্ষা করতে হবে

বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল (ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট) সুন্দরবনে পৃথিবীখ্যাত বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। একই সঙ্গে বিরল প্রজাতির ডলফিন, কচ্ছপ, পাখিসহ অসংখ্য বন্য প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র এ বনাঞ্চল। রামপাল প্রকল্পের কারণে এসব প্রাণীর জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

রামপাল প্রকল্প নির্মাণকারী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনেসকো একটি আন্তরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রতিবেদনের জবাব সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র দেবে। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই।’

ইউনেসকো সর্বশেষ অবস্থান নেওয়ার আগে চলতি বছরের মার্চে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থার জোট আইইউসিএনের সমন্বয়ে গঠিত একটি দলকে সুন্দরবনে পাঠায়। রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশন (আরএমএম) নামের ওই দল বাংলাদেশে ভ্রমণের সময় নাগরিক সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এ কার্যক্রমের আওতায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে সম্ভাব্য প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়। একই সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয় জলবায়ু পরিবর্তন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও জাহাজীকরণের নিরাপত্তায় নেওয়া প্রস্তাবগুলোও। এ জন্য ইউনেসকোর একটি প্রতিনিধিদল প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত স্থান, ২০১৫ সালের কার্গো দুর্ঘটনা ও চলতি বছরের তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনার স্থান পরিদর্শন করে।

সুন্দরবন নিয়ে ইউনেসকোর উদ্বেগ

জুলাই ২০১৪

ইউনেসকো রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে আপত্তি তোলে

ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনে তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনার পর রামপালসহ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অবৈধ নৌপথ নিয়ে আপত্তি তোলে

জুলাই ২০১৫

ইউনেসকোর বার্ষিক সাধারণ সভায় রামপাল প্রকল্প ও সুন্দরবনের নদীখনন নিয়ে বাংলাদেশ যথেষ্ট তথ্য দেয়নি, এ অভিযোগ ওঠে

ডিসেম্বর ২০১৫

রামপালসহ অন্যান্য প্রকল্পের প্রভাব খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশে একটি মিশন পাঠানোর ঘোষণা দেয় ইউনেসকো

আগস্ট ২০১৬

সরকারকে ইউনেসকোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন। এতে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা ধরে রাখতে রামপাল প্রকল্প বাতিলসহ তিনটি শর্ত দেয়

অক্টোবর ২০১৬

ইউনেসকোর প্রতিবেদনের জবাব দেয় সরকার। এরপর আবারও রামপাল প্রকল্প বাতিল করে তা অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলে ইউনেসকো