শেরপুরে হাতির তাণ্ডবে দেড় মাসে নিহত ৯

‘এক মাস ধইরা আমগর ঘুম নাই। হাতির থাইক্যা বাঁচবার জন্য পাহারা দিতাছি। কিন্তু প্রায় দিনই হাতি বাড়িঘরে হামলা করতাছে আর ফসল নষ্টসহ মানুষ মারতাছে। আমগর জীবনের নিরাপত্তা নাই। সরকার যদি আমগরে অন্য জায়গায় নিয়া যায়, তাও যাইতে রাজি আছি। তবু আমরা বাঁচবার চাই।’
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের উত্তর পানবর গ্রামে বন্য হাতির আক্রমণে নিহত জহুরুল হকের স্ত্রীর বড় ভাই আবদুস ছামাদ হাতির তাণ্ডব থেকে বাঁচার জন্য এভাবেই আকুতি জানান। ১৩ অক্টোবর উত্তর পানবর ও গুরুচরণ দুধনই গ্রামে হাতির আক্রমণে জহুরুলসহ তিনজন প্রাণ হারান।
কাংশা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনারউল্লাহ বলেন, হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এখন অর্থ সহায়তা চায় না। তাঁরা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়। শেরপুর-৩ (শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী) আসনের সাংসদ এ কে এম ফজলুল হক বলেন, এ থেকে পরিত্রাণ পেতে বিষয়টি নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সংসদে আলোচনা করবেন।
জেলা প্রশাসন, বন ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানায়, হাতির আক্রমণে সর্বশেষ ১৭ অক্টোবর শ্রীবরদীর খাড়ামুরা গ্রামের ইয়ার আলী নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী সীমান্তের গারো পাহাড় এলাকায় হাতির তাণ্ডবে ১১ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত দেড় মাসেই প্রাণ হারান নয়জন। আহত হয়েছেন আরও ২০ জন। এই সময়ে হাতির আক্রমণে ২০-২৫টি বসতঘর ও শতাধিক একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। দেড় মাস ধরে হাতির দল ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদীর সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান করছে। ফলে এলাকাবাসী হাতি-আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।
ঝিনাইগাতীর হাতি আক্রান্ত বাকাকুড়া, পানবর, গুরুচরণ দুধনই ও তাওয়াকুচা গ্রামের বেশ কয়েক ব্যক্তি বলেন, ১০-১৫ বছর আগে এলাকাবাসী মশাল জ্বালিয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে এবং টিন বাজিয়ে হাতি তাড়াতে পারতেন। কিন্তু এখন হাতির সংখ্যা বাড়ায় এসব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।
হাতির আক্রমণে আহত গুরুচরণ দুধনই গ্রামের নিয়ামত আলী বলেন, হাতির আক্রমণে তাঁর বাবা রুস্তম আলী ও চাচা আবদুল হাই নিহত হয়েছেন। হাতির ভয়ে তিনি খেতখামারে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। রুটি রুজি বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা বাঁচবেন কীভাবে?
৭ অক্টোবর রাতে হাতির দল পশ্চিম বাকাকুড়া গ্রামের চারটি বসতঘর গুঁড়িয়ে দেয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত বানেছা বেগমসহ অন্যরা বলেন, তাঁরা এখন গৃহহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
তাওয়াকুচা টিলাপাড়া গ্রামের মোমেনা বেগম বলেন, ১৭ অক্টোবর হাতি তাঁর বসতঘর ভেঙে দিয়েছে। এখন কোথায় থাকবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
ঝিনাইগাতীর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাদশা বলেন, হাতিগুলো ভারত থেকে আসে। সীমান্তে ভারতের দেওয়া কাঁটাতারের বেড়ায় কয়েকটি করিডর আছে। এসব করিডর দিয়ে হাতিগুলো বাংলাদেশে ঢুকেছে। বর্তমানে করিডর বন্ধ থাকায় এসব হাতি ভারতে যেতে পারছে না। তাই ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সীমান্তের এসব করিডর সার্বক্ষণিক খোলা রাখার ব্যবস্থা করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যথায় জীবন রক্ষার জন্য প্রায় তিন হাজার পরিবারকে এ সীমান্ত এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যেতে হবে।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোবিন্দ কুমার রায় বলেন, হাতির আক্রমণ থেকে জানমাল রক্ষায় সরকারিভাবে বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সীমান্তের ১১ কিলোমিটার এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে সোলার ফেন্সিং ও বায়োলজিক্যাল ফেন্সিং নির্মাণ এবং কাঁটাযুক্ত বেত ও লেবুবাগান তৈরি করা। তবে হাতিকে বিরক্ত না করার জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে তিনি অনুরোধ জানান।
ঝিনাইগাতীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেন, হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সন্ধ্যার আগেই সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে নারী ও শিশুদের সরিয়ে আনা হচ্ছে। এ ছাড়া রাতে প্রশাসন, বিজিবি, বন বিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের সমন্বয়ে পাহারার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক এ এম পারভেজ রহিম বলেন, সীমান্তের করিডরগুলো সার্বক্ষণিক খোলা রাখার বিষয়ে তিনি মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার ডিসির সঙ্গে কথা বলবেন। হাতির আক্রমণে হতাহতের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অর্থ সহায়তা দেওয়ার জন্য তিনি ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।