চাপ মোকাবিলা করতে হবে সুসাংবাদিকতা দিয়ে

বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার নানামুখী চাপের কথা স্বীকার করে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা বললেন, এই চাপের সঠিক জবাব হতে পারে সুসাংবাদিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আর মানুষের আস্থা অর্জন এবং তাদের মনের ভাষা বুঝে সংবাদ পরিবেশন করা।

আজ শনিবার সকালে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত ‘সাংবাদিকতার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। গত ৪ নভেম্বর ছিল প্রথম আলোর ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই উপলক্ষে আজ এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।

সেমিনারে সাংবাদিকেরা বলেন, সাংবাদিকতায় চাপ আসে। অনেক সময় ভয়ভীতিও দেখানো হয়। সাংবাদিকতার চাপকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এটা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে। এই চাপ ও ভয়ভীতির বিরুদ্ধে সঠিক জবাব হতে পারে ভালো সাংবাদিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। তাঁরা আরও বলেন, মানুষ কী চায়, সেটা দেখতে হবে। তাদের মনের কথা বুঝতে হবে। গণমাধ্যম তাদের ভাষায় কথা বললে কোনো চাপ কার্যকর হবে না। তাঁরা বলেন, যত হুমকি বা চাপই আসুক না কেন, পেশাগত নীতি ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে হবে। গণমাধ্যম যত বেশি গণমানুষের কাছে যাবে, তত বেশি জনপ্রিয় হবে এবং তাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে।

সেমিনারে আলোচনা সূচনা করেন ভারতের দৈনিক দ্য হিন্দুর সম্পাদক মুকুন্দ পদ্মনাভন। তিনি বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার ওপর যে হুমকি ও চাপ রয়েছে, তা সততা ও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার আহ্বান জানান। তৃণমূল পর্যায়ের সাংবাদিকদের স্থানীয় প্রশাসনের হুমকির মুখে থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে তা তৃণমূল পর্যায় থেকেই কাজটি শুরু করতে হবে। মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখতে এর অনলাইন বিভাগ থেকে আয়ের পরিমাণ বাড়ানোরও তাগিদ দেন তিনি।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর প্রধান সম্পাদক রাজ কমল ঝা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এখন রাজনীতিকেরা এই মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের পক্ষে প্রচার চালান; তাঁরা দলের ও নিজের কথা প্রচার করেন। ফলে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়‌ে। তাঁর মতে, গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে, সেটি ভালো সাংবাদিকতা দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে।

ফিনল্যান্ডের দৈনিক হেলসিঙ্গিন সানোমাট-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা কারি হুতা মুদ্রিত পত্রিকার প্রচারসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, মানসম্মত সাংবাদিকতা দিয়েই এই সংকট কাটানো যেতে পারে।

আনন্দবাজার পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক স্বাতী ভট্টাচার্য জনগণের সঙ্গে গণমাধ্যমের দূরত্ব থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কিংবা তরুণেরা যে ভাষায় পড়তে চান, আমরা এখনো সেই ভাষায় লিখছি না। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। মফস্বলে প্রশিক্ষিত সাংবাদিকের অভাব রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।’

চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, মফস্বল পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে তাঁকে প্রতিযোগিতা করতে হয়। তাঁর পত্রিকার অনলাইনে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সচিত্র খবর থাকে, এই তথ্য জানিয়ে তিনি এই আশা প্রকাশ করেন যে প্রতি হিটে এক পেন্স ফি ধরা হলেও আয় বাড়বে।

ঢাকা ট্রিবিউন-এর সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, ‘আমরা আশা করতে চাই ভালো সাংবাদিকতা ভালো ব্যবসা করবে। কিন্তু লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ান-এর ক্রমাগত লোকসান সেটি সমর্থন করে না।’

ইংরেজি দৈনিক নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ যুক্তরাষ্টের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেন, গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে।

দৈনিক ইত্তেফাক-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, মুদ্রিত সংবাদপত্রে জন্য এখন অর্থনৈতিক ঝুঁকি বেড়েছে। অনলাইনে বিনা মূল্যে খবর পাওয়া যায় বলে অনেকেই পত্রিকা কিনে পড়ছেন না।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলও মার্কিন নির্বাচনের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক কমে গেছে। এটি পুনরুদ্ধারই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জনগণ কোন ভাষায় খবর পড়তে ও শুনতে চায়, তা আমরা এখনো রপ্ত করতে পারিনি।’

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী সেলফ সেন্সর বা স্বনিয়ন্ত্রণ স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে অন্যতম বাধা বলে মন্তব্য করেন।

ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (আইপিআই) নির্বাহী পরিচালক বারবারা ত্রিয়োনফি বলেন, গণমাধ্যমের ওপর সরকার ও রাজনৈতিক মহলের চাপ থাকবে। তারা কখনো কখনো আইনি ব্যবস্থা নেবে, অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করবে। কিন্তু তাতে দমে গেলে চলবে না। এসব চাপ মোকাবিলা করেই সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে হবে।

ভারতের দৈনিক ভাস্কর-এর সম্পাদক প্রকাশ দুবে বলেন, স্বার্থান্বেষী মহল সব সময় প্রশ্ন শুনতে ভয় পায়। কিন্তু সাংবাদিকদের সেই প্রশ্ন করে যেতে হবে। তাঁর মতে, সাংবাদিকদের বাধা কেবল রাজনৈতিক মহল নয়, করপোরেট হাউসও। গণতন্ত্র, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা এমনকি সংবাদপত্রও এখন অনেক ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই ব্যয় সংকুলানের জন্য বিজ্ঞাপন নিতে হয়। তবে সজাগ থাকতে হবে কোনোভাবেই যেন বস্তুনিষ্ঠতা ক্ষুণ্ন না হয় এবং নতুন পাঠক ধরতে গিয়ে যেন পুরোনো পাঠক না হারাই।’

ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (আইপিআই) বোর্ড চেয়ারম্যান জন ইয়ারউড এই আয়োজনের জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, গণমাধ্যমের সামনে এখন তিনটি চ্যালেঞ্জ: অর্থনৈতিক, পারস্পরিক সহযোগিতা ও স্বাধীনতা। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী মুদ্রিত পত্রিকার মুনাফা ও সার্কুলেশনও কমেছে। জাম্বিয়ায় বিরোধী দলের পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ১২ জন সাংবাদিককে জেলে পাঠানো হয়েছে; তুরস্কেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। এসবের বিরুদ্ধে আইপিআই তাঁর সদস্যদের নিয়ে লড়াই করছে।

সমাপনী ভাষণে মাহ্‌ফুজ আনাম সাংবাদিক ও সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, অন্যান্য সংস্থা সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানালেও সংবাদ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সে রকম উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। প্রথম আলোর এ উদ্যোগ অন্যান্য সংবাদপ্রতিষ্ঠানও অনুসরণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সবশেষে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান অভ্যাগতদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি।’

সেমিনারে বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর ১৯ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন নেপালের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক কান্তিপুর-এর প্রধান সম্পাদক সুধীর শর্মা, ভারতভিত্তিক সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়ার প্রেসিডেন্ট জ্যোতি মালহোত্রা, ভুটানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও দেশটির জাতীয় দৈনিক কুয়েন সেল-এর সম্পাদক রিনঝিন ওয়াংচুক, ভারতের আসামের বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ-এর সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরী, ভারতের ত্রিপুরার দৈনিক দেশের কথা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গৌতম দাশ, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সাপোর্টের (আইএমএস) কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এসবেন হারবো, বিবিসি স্কটল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলীয় দ্বীপবিষয়ক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক স্যান্ডি ব্রেমনার, স্লোভাকিয়ার দৈনিক এসএমইতে কর্মরত সাংবাদিক মাতুস কার্চমরিক, মেঘালয়ের সবচেয়ে পুরোনো ইংরেজি দৈনিক দ্য শিলং টাইমস-এর সম্পাদক প্যাট্রিসিয়া মুখিম, ভুটানের জাতীয় দৈনিক কুয়েনসেল-এর প্রকাশনা বিভাগের সম্পাদক উগেন পেনজর, গার্ডেনস অব দ্য রাইচাস ওয়ার্ল্ডওয়াইডের (গারিও) প্রতিনিধি এমিলিও বারবারানি, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস দক্ষিণ এশিয়া সংবাদ পরিচালক বার্নাত আরমাঙগে।

দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের আলোচনা
দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের আলোচনা

সেমিনারে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান, ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোরের সামিয়া রহমান, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের নির্বাহী সম্পাদক খালেদ মুহিউদ্দিন, এএফপির ব্যুরো প্রধান শফিক আলম, রয়টার্সের ব্যুরো প্রধান সিরাজুল ইসলাম কাদির। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গবেষক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, সংবাদ প্রতিদিন-এর সম্পাদক আবেদ খান, নয়া দিগন্ত-এর সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দীন, সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুন হাবীব, সমকাল-এর উপসম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, জনকণ্ঠ-এর নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, ভোরের কাগজ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক সুজাত, একাত্তর টেলিভিশনের পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, ইত্তেফাক-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আশিস সৈকত, ঢাকা বাংলা টেলিভিশনের সম্পাদক প্রণব সাহা, বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ডেইলি স্টার-এর সহযোগী সম্পাদক শাহেদুল আনাম খান, ডেইলি স্টার-এর উপসম্পাদক আশা মেহরিন আমিন, এনটিভির বার্তাপ্রধান খায়রুল আনোয়ার, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি জামাল উদ্দীন, এপির সংবাদদাতা জুলহাস আলম প্রমুখ।