বুক দিয়ে বন আগলে রেখেছেন পাড়াবাসী

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় আট গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই পাহারা দেন সংরক্ষিত বন। গ্রামবাসীকে সহায়তা করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাজিংডং। বনের গাছপালা ও বন্য প্রাণী নিধন বন্ধে এককাট্টা তাঁরা। তুলাছড়ি গ্রামের বনের চারপাশে সীমানাপ্রাচীর তৈরির কাজ করছেন পাড়ার বাসিন্দারা l ছবি: সংগৃহীত
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় আট গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই পাহারা দেন সংরক্ষিত বন। গ্রামবাসীকে সহায়তা করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাজিংডং। বনের গাছপালা ও বন্য প্রাণী নিধন বন্ধে এককাট্টা তাঁরা। তুলাছড়ি গ্রামের বনের চারপাশে সীমানাপ্রাচীর তৈরির কাজ করছেন পাড়ার বাসিন্দারা l ছবি: সংগৃহীত

পাড়ার চারপাশে সংরক্ষিত বন। সেই বন পাহারা দেন পাড়ার বাসিন্দারাই। বনের গাছপালা ও বন্য প্রাণী নিধন বন্ধে এককাট্টা তাঁরা। এ জন্য তাঁরা বন সংরক্ষণ কমিটিও করেছেন। পাড়ার বাসিন্দাদের ঘর তৈরিতে গাছ বা বাঁশ কাটার প্রয়োজন হলে এই কমিটির অনুমতির প্রয়োজন হয়। বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে গাছপালা ও বন্য প্রাণীর তালিকাও তৈরির কাজ চলছে। বনের চারদিকে সীমানাপ্রাচীরও দেওয়া হয়েছে। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের প্লেদয় ম্রোপাড়ার বাসিন্দারা এভাবেই বন আগলে রেখেছেন।

বান্দরবান সদর থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে প্লেদয় ম্রোপাড়ার অবস্থান। এই পাড়াসহ রোয়াংছড়ির নয়টি পাড়ার বাসিন্দারা এভাবে বন রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। বন সংরক্ষণে পাহাড়ি বাসিন্দাদের পুরোনো ঐতিহ্য আবার ফিরে এসেছে এই পাড়াগুলোতে। আর এই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনাতে এলাকাবাসীর মধ্যে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্বটি নিয়েছে বান্দরবানের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাজিংডং। এ লক্ষ্যে ঢাকার আরণ্যক সংস্থার সহায়তা নিয়ে গত আট বছর ধরেই তাজিংডং কাজ করে চলেছে।

আর এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাজিংডং পেয়েছে বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশবিষয়ক পুরস্কার ‘দ্য এনার্জি গ্লোব অ্যাওয়ার্ড-২০১৬। ১০ নভেম্বর মরক্কোর মারাক্কেশে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

েই পানি পাইপের মাধ্যমে আনা হয় পাড়ার পাশের ট্যাংকে l ছবি: সংগৃহীত
েই পানি পাইপের মাধ্যমে আনা হয় পাড়ার পাশের ট্যাংকে l ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রিয়ার নাগরিক উলফগাং নয়মানের প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক সংস্থা এনার্জি গ্লোব ফাউন্ডেশন এই পুরস্কার দিয়ে থাকে। সংস্থার ওয়েবসাইটে জানানো হয়, ছয়টি বিভাগে পুরস্কারের জন্য ১৭৮টি দেশ থেকে দুই হাজার প্রকল্প জমা পড়ে। জুরিবোর্ডের সদস্যরা এর মধ্য থেকে প্রথমে ১৭টি প্রকল্প বাছাই করেন। পরে সেখান থেকে সেরা ছয়টি প্রকল্প নির্বাচন করে জুরিবোর্ড। তাজিংডংয়ের প্রকল্প পুরস্কার পেয়েছে ‘আর্থ’ বিভাগে। পরিবেশের ক্ষেত্রে অস্কার হিসেবে খ্যাত এই পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯৯৯ সালে।

তাজিংডংয়ের নির্বাহী পরিচালক অংশৈসিং মারমা বলেন, পার্বত্য এলাকার মানুষজন ঐতিহ্যগতভাবেই বনের দেখাশোনা করেন। বাইরের নানা চাপে এই প্রথা ভেঙে পড়েছিল। এখন তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে এটা আবারও চালু করতে চাইছেন। এ জন্য ‘সামাজিক অংশগ্রহণে গ্রামীণ সাধারণ বন সংরক্ষণ’ প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

তাজিংডংয়ের এই অর্জনের খবর ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে। কিন্তু বাস্তবে তা কত দূর ফলপ্রসূ হয়েছে, প্লেদয় পাড়া তারই উদাহরণ। সম্প্রতি এই পাড়ায় গিয়ে বন সংরক্ষণে নেওয়া বাসিন্দাদের নানা পদক্ষেপের কথা জানা গেল। প্লেদয় পাড়ার পাশে সংরক্ষিত বনে প্রবেশ করতেই দেখা গেল গর্জন, সিবিট, বহেড়া, হরীতকী, আমলকীসহ ছোট–বড় অসংখ্য বৃক্ষ ও লতাগুল্মে ছেয়ে আছে চারপাশ। সারা বন পাখির কলকাকলিতে মুখর। কাঠবিড়ালি, বন মোরগ ও হরিণেরও দেখা মিলল বনের নানা অংশে। ২২ পরিবারের এই পাড়ার বাসিন্দাদের জন্য সুপেয় পানির রিজার্ভার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে তাজিংডংয়ের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি বন থেকে কুড়িয়ে আনা মরা গাছের ডালাপালা দিয়েই যাতে রান্নার কাজ চলে সে জন্য সরবরাহ করা হয়েছে উন্নত চুলা। পাড়ার প্রতিটি ঘরে এখন এই চুলা ব্যবহার হচ্ছে। এই চুলায় কম জ্বালানি লাগে, তা ছাড়া ধোঁয়াও কম তৈরি হয়। এ জন্য বনজ সম্পদ রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশদূষণও কমেছে।

এভাবে বন সংরক্ষণ করে পাড়াবাসীর কী লাভ হচ্ছে জানতে চাওয়া হয়েছিল অনেকের কাছে। পাড়ার বাসিন্দা মান্দি ম্রো এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, এই বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে একটি পাহাড়ি ঝিরি। পাড়াবাসীর পানির প্রধান উৎস এই ঝিরি। যদি গাছ না থাকে, তবে ঝিরিটি শুকিয়ে যাবে। তখন পানির সংকটে পড়বে সবাই। ফলে পাড়ার অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।

বন সংরক্ষণ করায় প্লেদয় ম্রোপাড়ার পাশের ঝরনায় এখন সারা বছরই পানি থাকে l ছবি: সংগৃহীত
বন সংরক্ষণ করায় প্লেদয় ম্রোপাড়ার পাশের ঝরনায় এখন সারা বছরই পানি থাকে l ছবি: সংগৃহীত

বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্বও নিয়েছেন পাড়ার বাসিন্দারা। বনের যেকোনো ধরনের পশুপাখি ধরা ও শিকার নিষিদ্ধ করেছে পাড়ার বন সংরক্ষণ কমিটি। এ কাজে বন বিভাগকে পাহারা বসাতে হয়নি। মান্দি ম্রো বলেন, বনে এখন বিস্তর মায়া হরিণও আছে। তারা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারছে।

প্লেদয় পাড়ার কার্বারি ও বন সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি কামচ্যং ম্রো বলেন, গাছ পাচারকারী ও বনদস্যুদের এলাকায় আসতে দেন না গ্রামের বাসিন্দারা। একসময় পাড়ায় এসে গাছ কাটার জন্য গ্রামবাসীদের প্রলোভন দেখাত তারা। কিন্তু সবার মাঝে সচেতনতা গড়ে ওঠায় এটি বন্ধ হয়েছে। এখন আর পাচারকারীরা এখানে আসে না।

তিনি আরও বলেন, বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তাঁরা। এতে কাজ করতে অনেক সুবিধা হয়েছে। তাঁরা বনের সীমানাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বনে কত প্রজাতির গাছ, বাঁশ, লতাগুল্ম রয়েছে তার তালিকাও করা হচ্ছে।

পাড়ার পাশের বিশাল পানির রিজার্ভার থেকে পানি নিতে এসেছিলেন গৃহবধূ চেক্রে ম্রো। তিনি বলেন, এখন আর পানির সমস্যা নেই। আগে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহে সারা দিন ব্যস্ত থাকতে হতো। পানিও ছিল দূষিত। এখন পরিশোধিত পানি পাওয়া যাচ্ছে।

তাজিংডংয়ের কর্মসূচি কর্মকর্তা পাইসিউ মারমা বলেন, তাঁরা প্লেদয় পাড়াসহ রোয়াংছড়ি উপজেলায় বনের পাশে অবস্থিত নয়টি পাড়ার মানুষজনকে বন রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করছেন। বনের ওপর নির্ভরতা কমাতে বাসিন্দাদের বন ব্যবস্থাপনা, হস্তশিল্প ও সবজি চাষের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তিনটি পাড়ায় আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে পাড়াবাসীকে তহবিলও দেওয়া হয়েছে। ওই তহবিল পাড়াবাসীই পরিচালনা করেন। তাঁরা ঋণ নিয়ে কাজ শেষে আবার ফেরতও দেন। এ ছাড়া প্রতিটি পাড়ায় পাহাড়ি ঝরনা থেকে পানি সরবরাহ করা হয়। কম জ্বালানিতে রান্নার জন্য উন্নত চুলাও দেওয়া হয়েছে প্রতিটি পরিবারকে।

রোয়াংছড়ির বেক্ষং মৌজার প্রবীণ হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) ক্যশৈ অং মারমা বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে ৩০-৩৫ বছর আগেও প্রতিটি পাড়ার পাশে বন ছিল। কিন্তু সড়ক যোগাযোগের সুবিধা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঠপাচারকারীরা বন ধ্বংস করেছে। শত বছরের এ ঐতিহ্য আগের ফিরিয়ে আনা গেলে বন বাঁচবে।