সৌরবিদ্যুতে আলোকিত ১৭২ বর্গকিমি

সৌরবিদ্যুতে আলোকিত হয়েছে পটুয়াখালীর চরবিশ্বাস ও চরকাজলের জনজীবন। ছবিটি গত ২২ নভেম্বর তোলা l ছবি: প্রথম আলো
সৌরবিদ্যুতে আলোকিত হয়েছে পটুয়াখালীর চরবিশ্বাস ও চরকাজলের জনজীবন। ছবিটি গত ২২ নভেম্বর তোলা l ছবি: প্রথম আলো

১৭২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল এক চর। সবুজ গাছপালা চারদিকে। উত্তর-পূর্বে তেঁতুলিয়া নদী, পশ্চিমে বুড়াগৌরাঙ্গ নদ, একেবারে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ইঞ্জিন নৌকায় পাড়ি দিয়ে কাছাকাছি লোকালয়ে যেতেও সময় লাগে কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা।
পটুয়াখালীর প্রায় বিচ্ছিন্ন এই চরে দুটি ইউনিয়ন— চর বিশ্বাস ও চর কাজল। যোগাযোগ অবকাঠামো বলতে কিছু পিচঢালা পথ। তবে এর ওপর দিয়ে কখনো চলেনি মোটরগাড়ি। বাহন বলতে মোটরসাইকেল আর টমটম (শ্যালো ইঞ্জিনচালিত যান)। আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া প্রায় নেই।
তবু এই গ্রামে রাত নামলেই জ্বলে ওঠে বৈদ্যুতিক বাতি। কয়েকটি বাড়িতে টেলিভিশন আর ফ্রিজ। সৌরবিদ্যুৎ এখানকার ১৯টি গ্রামের ৬৪ হাজার মানুষকে আর বিচ্ছিন্ন থাকতে দেয়নি। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সূত্রে জানা গেছে, এখানকার প্রায় ৮৫ শতাংশ পরিবার সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।
পশ্চিম চর কাজল গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফা দরজি বলেন, ‘আগে আমাগো গেরামে কেরোসিন কিনতে পয়সা শেষ হইত। পোলাপাইনে পড়ালেখা করতে পারত না। অহন রাইতেই বই লইয়া বসে আমার তিন পোলাপাইন।’
পেশায় জেলে মোস্তাফা দরজি জানান, তাঁর ৪ শতাংশ জমির ওপর বানানো বাড়িতে ২৭ হাজার টাকা মূল্যের একটি সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানো হয় তিন বছর আগে। একটি বিতরণ প্রতিষ্ঠানকে কিস্তিতে প্রতি মাসে ৭৩০ টাকা দিতে হয়। ৩০ ওয়াটের এই প্যানেলে তিনটি বাতি জ্বালাতে পারেন। সূর্যের আলো পেলে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাতিগুলো জ্বালানো যায়। মোবাইল ফোন চার্জ দিতে পারেন।
চর কাজলের কাশেম হাওলাদার বলেন, সৌরবিদ্যুৎ আসার আগে কেরোসিন তেল কিনতে তাঁদের আয়ের বড় অংশ খরচ হতো। কেরোসিন আনতে অনেক সময় নদী পাড়ি দিয়ে যেত হতো। আমগাছিয়া ঘাট এলাকার দোকানে মোবাইল চার্জ দিতে হতো। একবার চার্জের মূল্য পাঁচ টাকা।
চর কাজল ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, ‘সৌরবিদ্যুৎ ছাড়া আমরা এখন অচল। তবে এই বিদ্যুতে টিভি দীর্ঘ সময় চালানো যায় না। ফ্রিজ চলবে না। তবু পরম পাওয়া এই সৌরবিদ্যুৎ।’
সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ব্যবহার করে ব্যবসাও করছেন চর বিশ্বাসের ইলিয়াস মৃধা। তিনি বলেন, আমগাছিয়া বাজারে তাঁর দোকান থেকে কম্পিউটার কম্পোজ, ই-মেইল, মোবাইল ফোনে চার্জ—সব চলছে। এ জন্য ২০০ ওয়াটের সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসিয়েছেন তিনি ৫০ হাজার টাকায়। এটি দিয়ে একটি ল্যাপটপ, দুটি ডেস্কটপ কম্পিউটার চালাতে পারছেন ইলিয়াস। দোকানে আটটি বাতিও জ্বলে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চর বিশ্বাস ও চর কাজলে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বিক্রি করছে। নগদে অথবা কিস্তিতে এগুলো কেনা যায়। ২০ ওয়াটের প্যানেলের মূল্য সাড়ে ৮ হাজার টাকা। ১৭০ ওয়াটের সৌর প্যানেল বসাতে খরচ পড়ে প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
বাণিজ্যিকভাবে এই এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ বিক্রি শুরু করতে যাচ্ছে গ্রিন হাউজিং অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেড (জিএইচএল) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। চর বিশ্বাস ও চর কাজলে ১০০ কিলোওয়াট করে মোট ২০০ কিলোওয়াটের দুটি আলাদা সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন করেছে তারা। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সাড়ে তিন কিলোমিটার তার টানা হয়েছে। এলাকার বাজার ও দোকানমালিকেরা তাদের ক্রেতা।
জিএইচএলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি ইউনিট ৩০ টাকায় কিনতে হবে। ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবেন তাঁরা। টিভি, ফ্রিজ—সবই চলবে।
কয়েক বছরের মধ্যে ১৭২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই চরাঞ্চল জাতীয়ভাবে বিদ্যুতের আওতায় আসবে—এমন আশার কথা শোনালেন চর বিশ্বাস ইউপির চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে এই এলাকায় ২০১৮ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ আসবে। প্রশাসন থেকে আমাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।