বিএনপি 'অবাক'

এত বড় ব্যবধানে দলীয় মেয়র প্রার্থীর পরাজয়ে অবাক হয়েছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এই ফলাফল ‘অস্বাভাবিক’। তবে এ পরাজয়ের পেছনে সাংগঠনিক ব্যর্থতাও আছে বলে মনে করছে দলটি।
নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তাঁদের কাছে প্রাথমিকভাবে এই হারের কিছু কারণ স্পষ্ট হয়েছে। আরও কিছু বিষয়কে সন্দেহে রেখে তা উদ্ঘাটন করতে দলের পক্ষ থেকে একটি কমিটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গতকালই সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে নানাভাবে কারচুপির সন্দেহের কথা জানিয়ে এ ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে বিএনপি।
দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, একটি বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর অভাবনীয় ভোটপ্রাপ্তি দলের ভেতরে চিন্তার উদ্রেক করেছে। এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে ভবিষ্যতের করণীয় ঠিক করতে না পারলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতেও এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তাই দলের নীতিনির্ধারকেরা সন্দেহের উদ্রেকে থাকা বিষয়গুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছেন।
বিএনপির সূত্র জানায়, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রাথমিকভাবে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছেন যে নারায়ণগঞ্জে দলের তিন গুরুত্বপূর্ণ নেতা তৈমুর আলম খন্দকার, গিয়াস উদ্দিন ও আবুল কালাম আজাদের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল না। তৈমুর আলম জেলা বিএনপির সভাপতি। আর গিয়াস উদ্দিন ও আবুল কালাম দলের সাবেক সাংসদ ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় নেতা। নির্বাচনের পর এ তিন নেতার ভূমিকা নিয়ে দলে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
জানা গেছে, ভোটের আগেই কেন্দ্রীয় নেতারা এই তিন নেতার তৎপরতা সম্পর্কে দলীয় প্রধানকে অবহিত করেছিলেন। এ অবস্থায় নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে তিন নেতাকে সতর্ক করেছিলেন। এর মধ্যে তৈমুর আলমকে নির্বাচন পর্যন্ত কোনো টেলিভিশনের টক শোতে অংশ নিতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
এ ছাড়া তৈমুর আলমের ভাই মাকসুদুল আলম খন্দকার, গিয়াস উদ্দিনের ছেলে গোলাম মুহাম্মদ সাদরিল ও আবুল কালামের ছেলে আবু কাউছার কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। আবুল কালামের ছেলে ছাড়া অন্য দুজন জিতেছেন। অভিযোগ আছে, এই তিন নেতা ভাই ও ছেলেদের ভোট নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
জানতে চাইলে তৈমুর আলম খন্দকার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো আপনাগো মিডিয়ার প্রচার। আমাদের যথেষ্ট চেষ্টা ছিল। নইলে যে লোকটার কোনো পরিচিতি নেই, যে কখনো সংগঠন করেনি, সে এত ভোট পাইল কেমনে?’
এ বিষয়ে গিয়াস উদ্দিন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ অনেক কিছুই বলে। দল এ বিষয়ে বক্তব্য চাইলে দেব।’ এই বিষয়ে আবুল কালামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
বিএনপির একটি সূত্রের দাবি, বিএনপির কেন্দ্রীয় অনেক নেতা নির্বাচনী কার্যক্রমে খুব আন্তরিক ছিলেন না। তাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত হননি। আবার কেউ কেউ কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন সমন্বয়ের অভাবের অভিযোগও তুলছেন। এ ক্ষেত্রে দলের একটি অংশ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ে দুর্বলতার কথাও বলছে।
জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘আমাকে এক দিন যেতে বলা হয়েছে, আমি গিয়েছিলাম। এটুকুই। এ নির্বাচনে সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন আমাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।’
জানতে চাইলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘কেউ যদি নির্বাচন সমন্বয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে, তাহলে সে দায় আমার ওপরই পড়ে। তবে আমি স্থানীয়ভাবে সমস্যা কাটানো এবং কেন্দ্রীয়ভাবে সবাইকে সমন্বয় করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এতে ঘাটতি ছিল বলে মনে হয় না।’
অবশ্য বিএনপির নেতাদের কারও মূল্যায়ন হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করে, সেখানকার সরকার হচ্ছেন স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান। আর বিরোধী দল হচ্ছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। এ কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা নবাগত সাখাওয়াত হোসেন খানের চেয়ে আইভীকে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন। এ ছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের একটি অংশের ভোটও আইভীর বাক্সে গেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আর এ নির্বাচনে জামায়াতের ভূমিকা ও তৎপরতা একেবারেই অদৃশ্য ছিল।
গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা স্বীকার করেন, প্রার্থী হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভী সব বিবেচনায় এগিয়ে ছিলেন। ব্যক্তি পরিচিতি ও ভাবমূর্তি বিবেচনায় নিলে আইভীর তুলনায় বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন অনেকটা পিছিয়ে। তারপরও বিএনপি আশাবাদী ছিল এই বিবেচনায় যে শেষ পর্যন্ত এটা নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের ভোট হবে। আর হারলেও সেটার ব্যবধান হবে কয়েক হাজারের।
দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে থেকেই তাঁরা কিছু বিষয়ে সন্দেহে ছিলেন। তাঁরা আশঙ্কায় ছিলেন, কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বাইরের পরিবেশ ঠিক রেখে ভেতরে পর্দার আড়ালে কিছু হয় কি না। এ ছাড়া ভোটের ৭২ ঘণ্টা আগে ‘বহিরাগত’ বলে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনী প্রচারের ওপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করা নিয়েও বিএনপিকে খটকায় ফেলেছিল। ৭৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এসব সন্দেহ এখন আরও ঘনীভূত হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের হিসাবে নারায়ণগঞ্জে ভোট পড়েছে ৬২ দশমিক ২ শতাংশ। তবে কেন্দ্রওয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফল গতকাল পর্যন্ত প্রকাশ করেনি নির্বাচন কমিশন। তারপরও অনানুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের চেয়ে আইভী ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৫টি ওয়ার্ডে বেশি ভোট পেয়েছেন। কেবল ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে আইভীর চেয়ে সাখাওয়াত বেশি ভোট পেয়েছেন। এ দুটি ওয়ার্ড সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অবস্থিত। বাকি দুটি থানা বন্দর ও সদরের সব ওয়ার্ডে আইভী জিতেছেন।
সাধারণ কাউন্সিলর পদে যে ১২টি ওয়ার্ডে বিএনপি জিতেছে, তার মধ্যে একটি ছাড়া (২ নম্বর ওয়ার্ড) বাকি ১১টিতে মেয়র পদে আইভী জিতেছেন। শামীম ওসমানের বাসভবন যে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত, সেখানেও আইভী জয় পেয়েছেন। নির্বাচনে আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট এবং সাখাওয়াত পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন যে পরিমাণ ভোট পড়েছে বলে দেখিয়েছে, সারা দিন ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির চিত্রের সঙ্গে মেলে না।
গতকাল বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নির্বাচনে ভয়ভীতির পরিবেশ বিদ্যমান ছিল, যার প্রতিফলন আমরা দেখলাম ভোটকেন্দ্রে স্বল্পসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি। কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ২৫ ভাগ। কোনো কোনো কেন্দ্রে সারা দিন ভোটার উপস্থিতি নগণ্য দেখা গেলেও ফলাফলে দেখা গেছে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়েছে।’
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়ক গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, যে ব্যবধানটা দেখানো হয়েছে, তা অস্বাভাবিক। কারণ, মাঠে-ময়দানে সরব ছিল বিএনপি। একটা পর্যায়ে তো প্রশাসন নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে নির্বাচনের এই ফলাফল অবিশ্বাস্য।
বিএনপি নির্বাচনের শুরু থেকে বলেছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তাহলে ফলাফল অবিশ্বাস্য হয় কীভাবে? জবাবে গয়েশ্বর রায় বলেন, ‘কোন কৌশল অবলম্বন করেছে, সেটা এখনো আবিষ্কার হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখার। ধরতে পারলে এটি আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হবে।’