মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে জগাখিচুড়ি

.
.

মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর কে ভুয়া, নতুন করে কারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন, সেটা যাঁরা যাচাই-বাছাই করছেন তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে উঠেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ।

সারা দেশ থেকে চিঠি, ফ্যাক্স ও ই-মেইলে এসব অভিযোগ আসতে থাকায় যাচাই-বাছাই কমিটিগুলো দফায় দফায় সংশোধন করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত কয়েক দিনে ৩৫টি জেলার ৪৫টি উপজেলার কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে পাঁচটি কমিটি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে। এরই মধ্যে শতাধিক উপজেলায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে দাবি করেছেন, যাচাই-বাছাই কমিটির ওই সদস্যদের সত্যিকার পরিচয় যাচাই-বাছাই করা উচিত। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা সাধারণ মানুষকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তুলে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, এত বিপুলসংখ্যক কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসা বিস্ময়কর।

মুক্তিযোদ্ধার পুরোনো তালিকায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এবং যাঁরা নতুন করে সনদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১২ জানুয়ারি একটি গেজেট প্রকাশ করে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে জমা পড়েছে প্রায় দেড় লাখ আবেদন। এ ছাড়া প্রতিদিনই আবেদন আসছে। সারা দেশে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৮টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি কাজ শুরু করে ২১ জানুয়ারি থেকে।

সাম্প্রতিক কয়েকটি অভিযোগ

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটির ফরহাদ হোসেন ও আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাতে তাঁরা বলেছেন, এ দুজন এলাকার নিরীহ লোকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া নাম তোলার আশ্বাস দিচ্ছেন।

তবে ফরহাদ হোসেন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমাকে হেয় করার জন্য এসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। পারলে অভিযোগ প্রমাণ করুক।’

অভিযোগকারীদের মধ্যে একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তের জন্য একজন মন্ত্রীও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছেন।

সাতকানিয়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত কমিটি থেকে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবু তাহের, ডেপুটি কমান্ডার মিলন কুমার ভট্টাচার্য, নুরুল আলম মন্টু ও নাছির উদ্দিনকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে ‘প্রকৃত’ মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবু তাহের পাল্টা অভিযোগ করেন, ‘হাফেজ আহমদ, নুরুল ইসলামসহ যাঁরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাঁরাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে কমিটি থেকে সরাতে পারলে তাঁরা সরকারি ভাতা চালুসহ যাচাই-বাছাইয়ের সময় প্রভাব দেখাতে পারবেন এই আশায় ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। আমি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ওনারা বাদ পড়ার ভয়ে কমিটি থেকে আমাকে সরানোর জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক হাফেজ আহমদ অভিযোগ করেন, ‘তালিকায় নাম তোলার কথা বলে সাতকানিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের আবেদনকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন।’

একই অভিযোগ এসেছে ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার যাচাই-বাছাই কমিটির সুলতান আহম্মেদ হাওলাদার ও মজিবর রহমানের বিরুদ্ধে। সুলতান আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চলছে।

তবে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে অভিযোগকারী নজরুল হক জমাদ্দারের দাবি, সুলতান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। এ বিষয়ে তাঁদের কাছে প্রমাণ আছে।

একইভাবে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা লিখিত অভিযোগ করেছেন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের যে প্রতিনিধি যাচাই-বাছাই কমিটিতে দেওয়া হয়েছে, সেই খলিলুর রহমান নিজেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। বিগত সরকারের আমলে তিনি ভুল তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। তাই তাঁর সনদ আগে যাচাই-বাছাইয়ের অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা।

নরসিংদীর পলাশ উপজেলার কমিটি থেকে মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান মিয়াকে বাদ দেওয়ার আবেদন এসেছে। এতে বলা হয়েছে, তিনি শতাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকায় তোলার সুপারিশ করেছেন।

রাউজানে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের কারও কারও লাল মুক্তি বার্তা এবং ভারতীয় তালিকায় নাম না থাকার অভিযোগ উঠেছে।

ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলা কমিটিতে বাইরের উপজেলা থেকে একজনকে সদস্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ফরিদপুরের উপজেলা কমান্ডার গফফার মিয়া।

অভিযোগ উঠেছে, নড়াইল জেলার যাচাই-বাছাই কমিটির জামুকা প্রতিনিধি মো. লিয়াকত হোসেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি অর্থের বিনিময়ে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বিশ্বাস।

শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাহাব উদ্দিনের নাম বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সেখানকার মুক্তিযোদ্ধারা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহাব উদ্দিন ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিলেন।

জানতে চাইলে সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। শত্রুতা করে সবাই এসব করছে।’

বেশ কয়েকটি কমিটি পুনর্গঠন

গত কয়েক দিনে ৩৫টি জেলার ৪৫টি উপজেলার কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচটি কমিটি স্থগিতও করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বিকেলে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছর আগে একবার কমিটি করা হয়েছিল। এরপর কিছু কমিটি নতুন করে করা হয়েছে। সারা দেশ থেকে কারও সুপারিশে কোনো কমিটি করা হয়নি। তবে আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে। তারপরও যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাঁদের বাদ দিয়ে সংশোধিত কমিটি প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো কোনো কমিটি বাতিলও করা হয়েছে।