এখনো অন্ধকারে র‍্যাব

>

.
.

তদন্তকারী র‍্যাব কর্মকর্তাকে ২১ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত

তদন্তের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চরম ব্যর্থতার উদাহরণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা। পাঁচ বছরে ৪৬ বার সময় নিয়েও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র‍্যাব। তদন্তের এই ব্যর্থতা নিয়ে নিহত সাগর-রুনির পরিবার ও স্বজনেরা ক্ষুব্ধ, ব্যথিত।

এদিকে গতকাল বুধবার ঢাকার মহানগর হাকিম মাজহারুল ইসলাম সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের এএসপি মহিউদ্দিনকে আগামী ২১ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামত পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে বলে এর আগে র‍্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। এখন সেই সব প্রতিবেদন র‍্যাবের হাতে। কিন্তু সেখান থেকে পাওয়া দুজন অজ্ঞাত পুরুষের ডিএনএ বহনকারী ব্যক্তি এখনো শনাক্ত হয়নি। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নিহত সাংবাদিক দম্পতির চুরি যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তদন্ত চলছে গ্রিলকাটা সন্দেহভাজন চোর ও ডাকাতের বিষয়েও। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার মোট আটজনের মধ্যে ছয়জন এখনো কারাগারে।

তবে এই হত্যা মামলার প্রথম দিকের তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, একদল চোর এই দম্পতিকে খুন করেছে। যদিও এর পক্ষে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেননি তাঁরা।

গত ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাড়িতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ মেলে। সাগর তখন মাছরাঙা টিভিতে আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ। হত্যাকাণ্ডে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনাস্থলে এসে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পুলিশকে তদন্ত শেষ করার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। সেই ৪৮ ঘণ্টা এখন পাঁচ বছরে গিয়ে ঠেকেছে। ২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনির হত্যারহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ৯ অক্টোবর ‘চমক দেওয়া’ সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। পরে সেই ব্যক্তিকে ধরেও মামলার কোনো সুরাহা হয়নি।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পরে প্রথমে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ ও পরে ডিবি এই মামলার তদন্তভার পায়। ডিবির তৎকালীন দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তাঁরা বলেন, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তাঁরা চারজনের একটি চোরের দলকে ধরেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মাহফুজ। মাহফুজকে নিয়ে ঘটনার ১০ দিন পর ওই এলাকায় যায় পুলিশ। মাহফুজ কর্মকর্তাদের দেখিয়ে দেন, কীভাবে ওই বাড়ির পাশে থাকা একটি মাঠে তাঁরা চারজন একত্রিত হন। এরপর মাহফুজ পাইপ বেয়ে উঠে দেখিয়ে দেন কীভাবে রাতের বেলা পাইপ বেয়ে তিনি চারতলায় উঠেছিলেন। ওই চোরের দলের কথামতো গলিয়ে ফেলা কিছু সোনার টুকরাও উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু ওই বাসা থেকে চুরি যাওয়া ল্যাপটপগুলো উদ্ধার করা যায়নি। সবকিছু উদ্ধার না করে মামলার প্রতিবেদন দিলে বিষয়টি মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না বলে মত দেন ডিবির ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। শেষ পর্যন্ত তাঁরা মামলার তদন্ত থেকে পিছিয়ে যান।

 তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় (২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল) হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র‍্যাবকে মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই থেকে র‍্যাব মামলাটি তদন্ত করছে। তদন্তভার পেয়েই ভিসেরা পরীক্ষার জন্য কবর থেকে সাগর-রুনির লাশ উত্তোলন করে র‍্যাব। র‍্যাবের কর্মকর্তারা জানান, ভিসেরা পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাঁদের মৃত্যুর আগে কোনো প্রকার বিষাক্ত বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করানো হয়নি। আর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ছুরিকাঘাতে রক্তক্ষরণ ও আঘাতের কারণে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

২০১৪ সালের আগস্টে আদালতে দেওয়া মামলার তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনে র‍্যাব জানায়, হত্যার স্থান থেকে জব্দ করা আলামতগুলোর মধ্য থেকে ছুরি, ছুরির বাঁট ও বঁটিতে খুনির আঙুলের ছাপ ও ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায় কি না, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া সাগর ও রুনির পরনের কাপড়, যে কাপড় দিয়ে সাগরের হাত ও পা বাঁধা হয়েছিল, গ্রিলের অংশ, ঘটনাস্থলে পাওয়া চুল, ভাঙা গ্রিলের পাশে পাওয়া মোজা, দরজার লক, দরজার চেইন, ছিটকিনি রাসায়নিক ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারে পাঠানো হয়। মামলায় গ্রেপ্তার করা আটজনসহ, সন্দেহভাজন ও নিহত সাগর-রুনির নিকটাত্মীয়—এ রকম মোট ২১ জনের লালা নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন, সাগর-রুনির স্বজন, সহকর্মীসহ মোট ১৫০ জনের জবানবন্দি নিয়েছে র‍্যাব।

এরপর ২০১৫ সালের ৭ জুন আদালতে দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে র‍্যাব জানায়, ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা আলামত যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে ফরেনসিক ও রাসায়নিক পরীক্ষার পর সেখান থেকে দুজন অজ্ঞাত পুরুষের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ বৃত্তান্ত পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‍্যাব সদর দপ্তরের তদন্ত ও ফরেনসিক শাখার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ওই দুজনকে খুঁজে বের করতে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। সন্দেহভাজন ১৩০ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘এই মামলার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যেসব আলামত যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর রিপোর্ট হাতে এসেছে। এগুলোর আলোকে তদন্ত করছি।’

গত বছরের ২ অক্টোবর আদালতে জমা দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে র‍্যাব জানায়, ‘ঘটনাস্থল থেকে চুরি হওয়া ল্যাপটপ বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা জানার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পত্রালাপ অব্যাহত আছে। হত্যার শিকার দম্পতি সাংবাদিক হওয়ায় এখনো তাঁদের অনেক সহকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রিলকাটা সন্দিগ্ধ চোর ও ডাকাতের বিষয়েও নিবিড়ভাবে তদন্ত অব্যাহত আছে।’

তবে কবে নাগাদ এই মামলার অভিযোগপত্র বা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হতে পারে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দীন বলেন, ‘সহসাই প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’ তবে তিনি দিন-তারিখ স্পষ্ট করেননি।

তারপরও কারাবাস

সব মিলিয়ে এই মামলায় এখন পর্যন্ত মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। তাঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই গত বছরের আগস্টে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র‍্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হন। প্রথম পাঁচজন ও নিরাপত্তারক্ষী এনামুল এখনো এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস করছেন। কর্মকর্তারা জানান, এই আটজনের কারও বিরুদ্ধে সাগর-রুনি হত্যায় জড়িত থাকার ন্যূনতম প্রমাণও মেলেনি।

বিচার না পেয়ে নিহত সাগরের মা সালেহা খানম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তদন্তকারীদের ওপর আমার আর কোনো ভরসা নেই। এখন ভরসা শুধু ওপরওয়ালার ওপর।’