ঠেঙ্গারচর বাসযোগ্য নয়?

>নোয়াখালীর ঠেঙ্গারচর নামে যে এলাকায় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি জোয়ারের সময় পানিতে ডুবে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে এ চরের কিছু অংশ দৃশ্যমান হলেও অতি জোয়ারের সময় ও বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হয়। ঠেঙ্গারচরে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানের ভূমি এখনো স্থায়িত্ব লাভ করেনি—মন্ত্রণালয়কে বন বিভাগের চিঠি
চামচ-ঠুঁটো বাটান নামে এই বিলুপ্তপ্রায় পরিযায়ী পাখিরা শীতকালে এসে আশ্রয় নেয় ঠেঙ্গারচরে l ছবি: সংগৃহীত
চামচ-ঠুঁটো বাটান নামে এই বিলুপ্তপ্রায় পরিযায়ী পাখিরা শীতকালে এসে আশ্রয় নেয় ঠেঙ্গারচরে l ছবি: সংগৃহীত

রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য নির্ধারিত ঠেঙ্গারচরের মাটি ও পরিবেশ এখনো মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়নি। বর্ষার পুরো সময়জুড়ে চরটি পানিতে ডুবে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে তা জেগে উঠলেও জোয়ারের সময় এর বড় অংশ পানিতে তলিয়ে যায়।

নরম মাটি ও কাদায় পূর্ণ ওই চরটিকে স্থায়ী করতে আট বছর ধরে বন বিভাগ সেখানে ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় প্রজাতির গাছ লাগাচ্ছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে চরটিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও পাখিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা স্পুন বিলড সেন্ড পাইপার টাস্কফোর্সের জরিপে দেখা গেছে, ওই চর-সংলগ্ন এলাকায় ৫৫ প্রজাতির পাখি বসবাস করে। দেশের উপকূলের মধ্যে হাতিয়ার পাশে ঠেঙ্গারচরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় শীতকালে ৫৫ প্রজাতির প্রায় ৫০ হাজার পাখি এসে বসত গড়ে। সেখানে সাত প্রজাতির প্রায় বিপন্ন, এক প্রজাতির বিপদাপন্ন এবং এক প্রজাতির পাখি রয়েছে, যা পৃথিবীজুড়েই মহা বিপদাপন্ন।
সংস্থা দুটির গবেষণায় দেখা গেছে, ওই চর এখনো মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। নরম মাটি ও জোয়ারের পানিতে বেশির ভাগ সময় ডুবে থাকে বলেই সেখানে এত পাখি আসে। মৎস্য অধিদপ্তর ওই এলাকাসহ ভোলা থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত মেঘনার অববাহিকাকে ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেখানে নিয়মিত ডলফিন বিচরণ করে।
৫ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগের পক্ষ থেকে ঠেঙ্গারচর নিয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, নোয়াখালীর ঠেঙ্গারচর নামে যে এলাকায় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি জোয়ারের সময় পানিতে ডুবে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে এ চরের কিছু অংশ দৃশ্যমান হলেও অতি জোয়ারের সময় ও বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হয়। ঠেঙ্গারচরে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানের ভূমি এখনো স্থায়িত্ব লাভ করেনি। জলযান থেকে নেমে হাঁটু পরিমাণ কাদা ডিঙিয়ে চরের অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে পৌঁছাতে হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ওই চরে কোনো বন্য প্রাণী নেই। কিছু বক ছাড়া সেখানে কোনো প্রাণী দেখা যায় না। আর সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষিত বন বাতিল করার সুযোগ আছে। সরকার সেখানে বেড়িবাঁধসহ অন্যান্য স্থাপনা করে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করতে পারে। কীভাবে সেখানে বসতি করা যায়, সে ব্যাপারে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বন বিভাগের সঙ্গে জেলা প্রশাসন কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ বছর ধরে আমরা দেশের উপকূলীয় এলাকার পাখি ও বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছি, এলাকাটি দেশের বিপন্নপ্রায় নানা পাখির শেষ আশ্রয়স্থল। সেখানে জোয়ারের পানির উচ্চতা ও কাদার পরিমাণ এতই বেশি যে কোনো মানুষের পক্ষে সেখানে বাস করা সম্ভব না। সরকার যদি সেখানে জোর করে রোহিঙ্গাদের বসতি করতে চায়, তাহলে তা হবে আত্মঘাতী। শেষ পর্যন্ত মানুষও সেখানে বসবাস করতে পারবে না। আর বন্য প্রাণী তার আশ্রয় হারাবে।’
বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল বন বিভাগ
৫ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগ থেকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সামুদ্রিক ঢেউ, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চরটি প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে আজ পর্যন্ত সেখানে কোনো বসতি গড়ে ওঠেনি। কক্সবাজারে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠেঙ্গারচরে পুনর্বাসন না করে স্থায়িত্ব লাভসহ চাষাবাদ উপযোগী একটি চরে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিয়েছিল বন বিভাগ। বন বিভাগ একই উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে দু-তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ঘাসিয়ার চরের ৫০০ একর সংরক্ষিত বনের পতিত এলাকায় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। বন বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, ঘাসিয়ার চরে ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করা হয়েছে এবং সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু জনবসতি স্থাপন করতে দেখা গেছে।
বন বিভাগ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে ওই চরটিকে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের অনুপযোগী হিসেবে তুলে ধরেছে। পাশাপাশি বন বিভাগ সেখানে সরকার যদি রোহিঙ্গা পুনর্বাসন করতে চায়, তাহলে মোট ছয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এসব পরামর্শ মেনে সরকার সেখানে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন করলে প্রথমেই সংরক্ষিত বনের মর্যাদা বাতিল করতে হবে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর সরকার এর জীববৈচিত্র্যের কথা চিন্তা করে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে।
অন্যদিকে বন বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, যদি ঠেঙ্গারচরে মানব বসতি করতে হয়, তাহলে এর চারদিকে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। চরটি স্থায়ী হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করতে হবে। পানীয় জলের ব্যবস্থা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক মোহাম্মদ সফিউল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগ সরকারের পক্ষে বনভূমি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকে। সরকার যদি ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের বসতি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে, তাহলে বন বিভাগ থেকে এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
বিপন্ন চামচ-ঠুঁটো বাটান পাখির আশ্রয়স্থল
ঠেঙ্গারচরের মাটি কাদা ও বালুর বিশেষ ধরনের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। সেখানে একধরনের পোকা হয়, যা খাওয়ার লোভে ওই চরে চামচ-ঠুঁটো বাটান নামে পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হতে যাওয়া এক জাতের পাখি শীতকালে বসত গড়ে। সারা পৃথিবীতে ওই পাখি আছেই মাত্র ২০০ জোড়া, যার ৬০ জোড়া আছে ওই চর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায়। এদের বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বন্য প্রাণীপ্রেমী ও গবেষকেরা মিলে চামচ-ঠুঁটো বাটান টাস্কফোর্স নামে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছেন।
স্পুন বিলড সেন্ড পাইপার টাস্কফোর্সের সমন্বয়কারী ক্রিস্টফ জক্লার এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই এলাকা শুধু বাংলাদেশের না, সারা বিশ্বের পাখির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ওই এলাকাটি বিশ্বব্যাপী বিপন্ন নরমানের সবুজ পা এবং বড় নট, সংকটাপন্ন দেশি গাংচশা এবং আরও অনেক পাখির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ওই পাখিগুলো রক্ষা করতে এদের আবাসস্থল ওই চরগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে জীববৈচিত্র্যের অধিকারকে যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১০ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে জলাভূমি ভরাট করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর ২০১২ সালে সংসদে অনুমোদন হওয়া জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বিপন্নপ্রায় প্রাণী বসতি এলাকা ধ্বংস করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এ ব্যাপারে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন), বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই চরটি উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য ও মহা বিপদাপন্ন পাখি চামচ-ঠুঁনো বাটানদের বসতি এলাকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের আগে সেখানকার প্রতিবেশব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্যের একটি মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করে তারপর সেখানে পুনর্বাসন বা কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর থেকেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠেঙ্গারচরে পুনর্বাসনের ব্যাপারে আপত্তি তোলা হয়েছে।

অারও পড়ুন