তালিকায় আছেন কৃষক বাবু মিয়ারা, বাস্তবে নেই

ঢাকার সাভার উপজেলার ঘোড়াদিয়া গ্রামের ‘কৃষক বাবু মিয়া’র কাছ থেকে তিন মেট্রিক টন ধান কিনেছে খাদ্য বিভাগ। কিন্তু ঘোড়াদিয়া গ্রামে বাবু মিয়া নামে কোনো কৃষক নেই। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে পাওয়া তালিকা থেকে ১৩০ জনের ঘটনা যাচাই করে এমন নানা অনিয়ম ধরা পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত বছর সাভার উপজেলা খাদ্য বিভাগ থেকে ৮৫৭ মেট্রিক টন বোরো ধান কেনা হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ২৯১ জন কৃষক এই ধান দিয়েছেন।
তথ্য অধিকার আইনে গত বছরের ১৬ আগস্ট সাভার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে একটি আবেদন করে প্রথম আলো। এতে ২০১৬ সালের বোরো ধান সংগ্রহের পরিমাণ এবং সরবরাহকারী কৃষকদের নাম-ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ে তথ্য না পেয়ে গত বছর ১ অক্টোবর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে আপিল করা হয়। আপিলেও সাড়া না পেয়ে ২৬ অক্টোবর তথ্য কমিশনে অভিযোগ করা হয়। গত ২৬ জানুয়ারি এ বিষয়ে কমিশনে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানির পর কমিশন কাঙ্ক্ষিত সব তথ্য সরবরাহ করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দেয়। এরপরও আংশিক তথ্য সরবরাহ করা হয়। ২৯১ জন কৃষকের যে তালিকা দেওয়া হয়, তাতে কারও বাবা-মায়ের নাম নেই। এমনকি তালিকায় সুনির্দিষ্ট কোনো ঠিকানাও নেই।
সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু নাসের বেগ বলেন, সরকারি অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবশ্যই অর্থ গ্রহণকারীর নাম, বাবার নাম ও সুনির্দিষ্ট ঠিকানা সংরক্ষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেন করা হয়নি, তা খতিয়ে দেখা উচিত।
গত ১৪ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি এ প্রতিবেদক ওই তালিকায় নাম থাকা অন্তত ১৩০ জনের ব্যাপারে সরেজমিনে খোঁজ নিতে যান। এর মধ্যে অন্তত ১১০ জনের ঠিকানায় গিয়ে ওই নামে কোনো কৃষকের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি।
উপজেলার ঘোড়াদিয়া গ্রামের বাবু মিয়ার কাছ থেকে তিন মেট্রিক টন ধান ক্রয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু ওই গ্রামের বাসিন্দা এবং সাভার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুল হাকিম বলেন, তাঁর গ্রামে বাবু মিয়া নামে কোনো কৃষক নেই।
একইভাবে সাভার পৌর এলাকার বিনোদ বাইদ মহল্লার এলেন খান, কামাল রোডের এনামুল হক, জালেশ্বরের জামাল মিয়া, আড়াপাড়ার দিলু মিয়া, উত্তর বাড্ডার ইউনুস ব্যাপারী এবং দক্ষিণ জামসিং এলাকার ওবায়দুর রহমানের কাছ থেকে তিন মেট্রিক টন করে ধান ক্রয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু এসব নামে ওই এলাকায় কোনো কৃষক খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি কৃষি কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সাভার পৌরসভা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ক্ষিতীশ চন্দ্র রায়কে খাদ্য বিভাগের সরবরাহ করা ওই তালিকা দেখানো হলে তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে পৌর এলাকায় এসব নামে কোনো কৃষক নেই।’
এ ছাড়া ধামসোনা এলাকার সামাদ, নয়ারহাট এলাকার রাখাল কর্মকার, ডেন্ডাবরের আসাদ, আমিনবাজারের আজিজ শেখ, ইয়ারপুরের জাকির হোসেন, রাজাশনের আহাদ, নরসিংহপুরের আজম আলীর কাছ থেকে তিন মেট্রিক টন করে ধান ক্রয় দেখানো হয়। এসব এলাকায় বারবার গিয়েও তাঁদের ঠিকানা খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয় ইয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বকুল হোসেন বলেন, বাবা-মায়ের নামসহ সুনির্দিষ্ট ঠিকানা ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ এসব এলাকায় কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা মুশকিল।
তবে তালিকা ধরে উপজেলার বক্তারপুর এলাকায় গিয়ে আবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে পাওয়া যায়। তবে তিনি কৃষক নন, ব্যবসায়ী। তাঁর কাছ থেকে তিন মেট্রিক টন ধান ক্রয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বললেন, তাঁর আবাদযোগ্য কোনো জমি নেই এবং খাদ্য বিভাগের কাছে তিনি কোনো ধান বিক্রি করেননি।
একইভাবে বক্তারপুর এলাকার ছাদেক হোসেনের নামে তিন মেট্রিক টন ধান ক্রয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু মাথা গোঁজার মতো তিন শতাংশ জমি ছাড়া কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই তাঁর। আর তালিকায় নাম থাকার বিষয়টি জানালে পৌর এলাকার ঘোড়াদিয়ার আবদুর রহমান বলেন, ‘খাদ্য বিভাগে ধান সরবরাহ দূরের কথা, গত সাত বছরে আমি কোনো ধানই বিক্রি করিনি।’
নিয়মানুযায়ী খাদ্যগুদামে ধান সরবরাহ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কৃষককে ব্যাংকে হিসাব খুলতে হয়। সোনালী ব্যাংকের সাভার শাখায় এমন ৩০ জনের ব্যাংক হিসাব যাচাই করে দেখা যায়, তাঁদের কেউই কৃষক নন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে তাঁদের নামে ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন।
জানতে চাইলে সাভার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিরঞ্জন চন্দ্র দাস বলেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে যে তালিকা দেওয়া হয়েছিল, তা ধরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হয়েছে। ওই সরবরাহকারীরা কৃষক কি না, তা যাচাই করার সুযোগ ছিল না।
তবে খাদ্য বিভাগের সরবরাহ করা তালিকা দেখানো হলে সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মফিদুল ইসলাম বলেন, ‘বোরো ধান সংগ্রহের জন্য আমার দপ্তর থেকে কৃষকদের যে তালিকা সরবরাহ করা হয়েছিল, তার সঙ্গে এই তালিকার কোনো মিল নেই।’