খুনের আসামিকে 'বৃদ্ধা' বিবেচনায় সাজা মাফের সুপারিশ

স্বামী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান তিনি। সাজার মেয়াদ শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। তাঁর সম্ভাব্য মুক্তির সময় ২০৩৯ সাল। মাঝে প্রায় ১৩ বছর জামিনে ছিলেন। এখন পর্যন্ত তিনি নয় বছরেরও কম সময় কারাভোগ করেছেন। অথচ এর মধ্যেই তাঁর অবশিষ্ট দীর্ঘ সাজা মওকুফের সুপারিশ করেছে আইন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ে ৪৮ বছর বয়সী এই নারীকে ‘বৃদ্ধা’ বিবেচনায় সাজা মওকুফের আবেদন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। 

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই আসামির নাম মাহবুবা সাত্তার ওরফে রুবী। মাহবুবার সাজা মওকুফের জন্য আবেদন করেছেন তাঁর দুই সন্তান মিনহাজ রহমান (জিশান) ও বুশরা মাহজাবিন। মায়ের অবশিষ্ট সাজা মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন তাঁরা। মাহবুবা সাত্তার বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে বন্দী আছেন।

অবশ্য বয়সের কারণে ক্ষমা পেতে পারেন—কারাবিধিতে এমন কোনো বিধান নেই। জানতে চাইলে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের জেল সুপার মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যে-কেউ ক্ষমার আবেদন করতে পারেন। তবে বয়সসংক্রান্ত কোনো নিয়ম নেই।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ১৯৯১ সালের ১১ মার্চ আবদুস সাত্তার হত্যার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরদিন ১২ মার্চ আবদুস সাত্তারের স্ত্রী মাহবুবা উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে একটি লিখিত দরখাস্ত করেন। এতে তিনি জানান, ঘটনার দিন আবদুস সাত্তার ভাঙ্গুরা ইটভাটা পরিদর্শন করে বাসায় ফিরে অস্বাভাবিক অবস্থায় নানা রকম আবোলতাবোল বলতে থাকেন এবং শুধু মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছিলেন। কোনো কাজকর্ম ভালো লাগে না বলে জানান। রাত ১১টার দিকে তাঁর স্বামীকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েন। ভোরে তাঁর স্বামী পাশের ঘরে ফজরের নামাজ শেষে কোরআন শরিফ পড়েন। সকাল ছয়টার দিকে তিনি ঘুম থেকে উঠে পাশের ঘরে গিয়ে ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় আবদুস সাত্তারকে দেখতে পান। পরে চৌকিদার আবদুস সামাদ ওরফে বাবলুকে ডেকে ঝুলন্ত আবদুস সাত্তারকে রশি কেটে নামিয়ে স্থানীয় চিকিৎসককে ডাকেন। চিকিৎসক আবদুস সাত্তারকে মৃত ঘোষণা করেন। মামলার এজাহারে স্বামীকে হত্যার পেছনে স্ত্রীর ‘সন্দেহ’ ও পারিবারিক টানাপোড়েনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মাহবুবার লিখিত দরখাস্ত পেয়ে উল্লাপাড়া থানার তৎকালীন ওসি সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে ফাঁসিতে মৃত্যুর কোনো লক্ষণ না পাওয়ায় তিনি ময়নাতদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সিরাজগঞ্জ মর্গে পাঠান।

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আবদুস সাত্তারকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সিরাজগঞ্জ হাসপাতালের চিকিৎসক আকরামুজ্জামান।

ঘটনাটিকে হত্যা জেনে ওসি নিজে বাদী হয়ে ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ মামলা করেন।

সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালের ২৭ অক্টোবর সিরাজগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ আসামি মাহবুবা সাত্তার ও আবদুস সামাদ ওরফে বাবলুর বিরুদ্ধে দুটি ধারায় দণ্ডাদেশ দেন। একটি ধারায় (দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪) দুই আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন। অপর আরেকটি ধারায় (দণ্ডবিধি ২০১/৩৪) তিন বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও দুই মাস করে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। আসামিরা পরে উচ্চ আদালতে আপিল করলে ২০০৯ সালের ২৭ ও ২৮ জুলাই মাহবুবার আপিল নামঞ্জুর হয়। অপর আসামি আবদুস সামাদের আপিল মঞ্জুর করা হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে মাহবুবা লিভ টু আপিল করলে ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর তা নামঞ্জুর হয়।

গত বছরের কারা বিবরণী অনুসারে, মাহবুবা সাত্তারের বয়স ৪৮ বছর। তাঁর সাজার মেয়াদ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে। তাঁর সম্ভাব্য মুক্তির তারিখ ২০৩৯ সালের ৩ জানুয়ারি। এর মধ্যে তিনি ১৯৯৭ সালের ৬ মার্চ থেকে ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১২ বছর ১০ মাস চার দিন জামিনে মুক্ত ছিলেন। মাহবুবা পুনরায় কারাগারে প্রবেশ করেন ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি। গত বছরের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত রেয়াতসহ তিনি মোট ৭ বছর ১০ মাস ২৬ দিন সাজাভোগ করেছেন।

এদিকে মা মাহবুবার অবশিষ্ট সাজা মওকুফের জন্য দুই সন্তান আবেদন করেন রাষ্ট্রপতির কাছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত যেকোনো দণ্ডের মার্জনা করতে পারেন, দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা কমাতে পারেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে যে-কারও সাজা মওকুফের আবেদন পাঠাতে হলে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে হয়। সে অনুযায়ী মতামত চাওয়া হলে আইন মন্ত্রণালয় জানায়, এই আসামির সাজা সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বহাল থাকলেও তিনি একজন ‘বৃদ্ধা নারী’। তাঁর ‘অসুস্থতা’র বিষয়টিকে ‘মানবিক’ বিবেচনা করে আরোপিত সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাহবুবার সাজা মওকুফের আবেদন আমরা পেয়েছি। তাঁর সাজা মওকুফ করার পক্ষে আমরা আইন মন্ত্রণালয়েরও মতামত পেয়েছি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাব।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের কাছে যে-কেউ ক্ষমা চেয়ে আবেদন করতে পারেন। আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে বিধিমোতাবেক সেই আবেদন পৌঁছে দেব। সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমা করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। তিনিই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।’

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মতামত পাঠিয়েছি, এটুকু মনে আছে।’