২১৩ শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক!

নেত্রকোনা সরকারি কলেজের মূল ফটক l ছবি: প্রথম আলো
নেত্রকোনা সরকারি কলেজের মূল ফটক l ছবি: প্রথম আলো

মাত্র ২৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হওয়া ৬৮ বছরের পুরোনো নেত্রকোনা সরকারি কলেজে এখন পড়াশোনা করছেন ১৩ হাজার ২১৬ জন। শিক্ষক আছেন ৬২ জন। অর্থাৎ, গড়ে ২১৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক আছেন। শ্রেণিকক্ষ ও আবাসনসংকটও প্রকট। এসব কারণে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
সম্প্রতি দুই দিন কলেজে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, এসব সংকটের কারণে ভাটি এলাকার এই বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে ওই এলাকার অসংখ্য শিক্ষার্থী একই সিলেবাসের স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কোর্সে পড়তে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে আসছেন।
১৯৪৯ সালে ৯ দশমিক ৬৫ একর জায়গার ওপর কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি হয় ১৯৮০ সালে। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও স্নাতক (সম্মান), পাস ও স্নাতকোত্তর স্তরে শিক্ষার্থী পড়ানো হয়। ১৪টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং ১০টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। পুরোনো কাঠামো অনুযায়ী কলেজে শিক্ষকের অনুমোদিত পদ আছে ৬৪টি। এর মধ্যে দুটি শূন্য। অথচ প্রশাসনিক সংস্কারসংক্রান্ত এনাম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী যেসব বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়, সেগুলোতে কমপক্ষে ১২ জন এবং যেসব বিষয়ে শুধু স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়, সেগুলোতে ৮ জন করে শিক্ষক থাকার কথা। এই কাঠামো অনুযায়ী পার্শ্ববর্তী জেলা ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজসহ অনেক কলেজেই শিক্ষক আছেন। কিন্তু নেত্রকোনা সরকারি কলেজে অধিকাংশ বিভাগেই মাত্র চারটি করে শিক্ষকের পদ আছে। কমপক্ষে ১৫২ জন শিক্ষক প্রয়োজন হলেও নতুন পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে না।
শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, শিক্ষকসংকটের কারণে প্রতিদিনই শিক্ষকদের ক্লাস নিতে হিমশিম খেতে হয়। ইংরেজি বিভাগে চারজন শিক্ষক আছেন; কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক, বিএ (পাস) ও স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষে সবার জন্য ইংরেজি বাধ্যতামূলক। এই হিসাবে বর্তমানে ইংরেজি পড়ুয়া শিক্ষার্থী ৬ হাজার ১৩২ জন। অর্থাৎ, ইংরেজি বিষয়ে গড়ে ১ হাজার ৫৩৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক ১ জন।
এই পরিস্থিতিতে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থীকে ইংরেজি বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এই শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম, তামান্না নুসরাত ও পলাশ হাসান।
শ্রেণিকক্ষের সংকট, ক্লাস হয় কম
বর্তমানে কলেজে শ্রেণিকক্ষ আছে ৩৬টি। অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক সময় এক বর্ষের ক্লাস চললে অন্য বর্ষের ক্লাস হয় না। দুই পালা (শিফট) করেও ঠিকমতো ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। তাঁদের ধারণা, বর্তমানে কমপক্ষে ৮৪টি শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২ হাজার ৫০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। শিক্ষকেরা এসব শিক্ষার্থীকে ক্লাস করাতে গিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ঠিকমতো ক্লাস নিতে পারেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্নাতক শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, বছরে গড়ে ৯০ থেকে ১২০ দিনের মতো ক্লাস হয়। এতে সিলেবাস শেষ হয় না। ফলে বাণিজ্য ও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়েন। অন্যরা নোট-গাইডের ওপর নির্ভর করেন।
আবাসনসংকট
কলেজে ১৩ হাজার ২১৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশ ছাত্রী। তাঁদের থাকার জন্য আছে ১০০ আসনের একটি ছাত্রীনিবাস। ছাত্রদের জন্য কোনো ছাত্রাবাস নেই।
আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় একাদশ বিজ্ঞান শ্রেণির ছাত্র আরিফুল ইসলাম শহরের সাতপাই এলাকায় একটি মেসে মাসিক ৮০০ টাকায় কক্ষ ভাড়া করে থাকতেন। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে নিরাপত্তাজনিত কারণে পূর্বধলার বাড়ি থেকে এসে ক্লাস করেন। এতে প্রতিদিন তাঁর আসা-যাওয়া বাবদ খরচ হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
দর্শন বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী রোখসানা আক্তার বলেন, ছাত্রীনিবাসে সিট না পাওয়ায় তাঁকে প্রতিদিন কলমাকান্দার ঘনিচা গ্রামের বাড়ি থেকে এসে ক্লাস করতে হয়।
ইতিবাচক দিকও কম নয়
এত সংকটের মধ্যেও এই কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ৬০ জন শিক্ষার্থী এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১২৩ জন অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১০ জন মেডিকেলে ও চারজন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হয়েছেন। কলেজের পরীক্ষার ফলাফল মোটামুটি ভালো।
কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে গঠিত ফোকলোর পর্ষদ লোকসাহিত্য গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চন্দ্র কুমার দে লোক গবেষণা পুরস্কার চালু করেছে। এ বছর গবেষক আশরাফ সিদ্দিকীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই বিভাগের উদ্যোগে প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ‘দ্রৌপদী চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর’ আয়োজন, প্রতিবছর ফাল্গুনের কবিতা ও দেয়ালপত্রিকা উৎসব, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া ও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আলোচনা করা হয় বলে জানান বাংলার বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আফজাল রহমান।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, শুধু এ জেলাই নয়, পাশের সুনামগঞ্জের ধরমপাশা, মধ্যনগর, ময়মনসিংহের গৌরীপুর ও কিশোরগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার শিক্ষার্থীরা এই কলেজে পড়ালেখা করেন। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ, আবাসন এবং শিক্ষকসংকটের কথা কয়েকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। হাওরাঞ্চলের কলেজ হিসেবে আলাদাভাবে বিবেচনা করে সংকট সমাধানে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।