বনের অপরাধী শনাক্তে ক্যামেরা-ফাঁদ

গাছে বাঁধা বুশনেল ক্যামেরা। এই ক্যামেরা গোপনে রেখে বনের অপরাধীদের চিহ্নিত করা যায় ছবি l সংগৃহীত
গাছে বাঁধা বুশনেল ক্যামেরা। এই ক্যামেরা গোপনে রেখে বনের অপরাধীদের চিহ্নিত করা যায় ছবি l সংগৃহীত

সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যের আয়তন প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের পূর্ব, দক্ষিণ এবং পশ্চিম—এই তিন অভয়ারণ্য মিলে এতটা বনাঞ্চল পাহারায় আছেন বন বিভাগের মাত্র ৪০ জন বনকর্মী। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এসব অভয়ারণ্যে বেঙ্গল টাইগার, কুমির, বন্য শূকর, বিরল প্রজাতির ডলফিন, হাঁস ইত্যাদির বিচরণ লক্ষ করা যায়। প্রতিবছর গড়ে একেকটি অভয়ারণ্যে অনধিকার প্রবেশসহ মাত্র পাঁচটি বন অপরাধ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। বাস্তবে অপরাধ হয় এর কয়েক শ গুণ বেশি।
কীভাবে তার প্রমাণ পাওয়া গেল? এই বনে গোপনে রাখা ক্যামেরা এই অপরাধের জানান দিয়েছে। সুন্দরবনের গহিন এই তিন অভয়ারণ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ক্যামেরা ফাঁদ পেতে তিন মাসে ৮৭২টি অপরাধ চিহ্নিত করা গেছে। বন বিভাগের কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন এবং তাঁর পাঁচ সহকর্মী গবেষক এই গবেষণা করেছেন। ক্যামেরার মাধ্যমে বন পাহারার পরীক্ষামূলক গবেষণা বাংলাদেশে এই প্রথম। ক্যামেরা ফাঁদ রাশিয়া, ভারত ও মালয়েশিয়ার বনে বন্য প্রাণী শিকার রোধে বেশ কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ক্যামেরার মাধ্যমে বন পাহারার এই বিষয়টি দেশে স্বল্প বনকর্মী, দুর্বল অবকাঠামো এবং জলযানের সংকটে ভোগা বন ব্যবস্থাপনায় আশার সঞ্চার করেছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন পাহারায় প্রযুক্তির ব্যবহার আমরাও চাই। তবে এ জন্য আমাদের যে পরিমাণ অর্থ ও লোকবল প্রয়োজন, তা আমাদের নেই।’
বাংলাদেশে যেসব বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য আছে, সেগুলোতে বাংলাদেশ বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ বলবৎ আছে। সেই আইন অনুযায়ী টহল, গবেষণা ও পর্যটন ছাড়া যেকোনো কাজে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে অবৈধ মাছ ধরা, কাঁকড়া ধরা, মধু সংগ্রহ, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, প্রাণী শিকার এবং সুন্দরীগাছ কাটার মতো অপরাধের ঘটনা ঘটে। বন বিভাগ অভয়ারণ্যগুলো বাদ দিয়ে অন্যত্র সীমিত মাত্রায় নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ধরা, সুন্দরীগাছের পাতা সংগ্রহ এবং মধু সংগ্রহের জন্য স্থানীয় মানুষকে অনুপতিপত্র দেয়।
আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, মাছ ধরার অজুহাতে অনুমতি নিয়ে অভয়ারণ্যে ঢুকে পড়ার প্রবণতা অত্যধিক। এর কারণ হলো অভয়ারণ্যে মাছ বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে বনজ সম্পদ আহরণ নিষেধ বলে ডাকাতের হাতে পড়ার আশঙ্কা কম থাকে। তাই তাদের চাঁদা না দিয়েই মাছ ধরার সুযোগ নিতে চায় অনেকেই।
অভয়ারণ্যগুলোতে এভাবে অবৈধভাবে প্রবেশের প্রবণতা কেমন, মূলত তা জানতেই এই ক্যামেরা ফাঁদ বসিয়ে এ গবেষণা করা হয়।
২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যে ক্যামেরার ফাঁদ বসানো হয়। প্রতিটি অভয়ারণ্যে অন্তত ২১ দিন করে এই ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। মোট ৪১টি ক্যামেরা ফাঁদ ব্যবহার করা হয় এ সময়। তবে শেষ পর্যন্ত ২০টি ফাঁদ টিকে থাকে। এর কারণ হিসেবে গবেষণায় ফাঁদ চুরি হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। তাঁরা অভয়ারণ্যের অভ্যন্তরের খালগুলোর দুই পাশে বুশনেল মডেলের ক্যামেরা পাতেন, যাতে পানিপথে মানুষ এবং নৌকার আসা-যাওয়ার চিত্র সহজেই ধরা পড়ে। ঘন বনের ভেতরে ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা হয়। মাটি থেকে এগুলো গড়ে ১ দশমিক ৬ মিটার উঁচুতে রাখা হয়। ক্যামেরার সামনে চলে আসা যেকোনো কিছুর পরপর তিনটি ছবি যাতে ওঠে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
যে মডেলের ক্যামেরা বসিয়ে সুন্দরবনে এই পরীক্ষা চালানো হয়েছিল, তার নাম বুশনেল। এ ধরনের ক্যামেরা তৈরি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতিটি ক্যামেরার মূল্য ৩০০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মুদ্রায় এটি প্রায় ২৪ হাজার টাকা। প্রতি ৩০ সেকেন্ড পরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তোলার ক্ষমতা ছিল ক্যামেরাগুলোর।
গবেষকেরা ক্যামেরা ফাঁদ পেতে ৬৪ দিনে ৯১৪ বার প্রবেশের সুনির্দিষ্ট নমুনা ছবি পান। এর মধ্যে ৮৭২টিই ছিল অবৈধ প্রবেশ। ৪২টি বৈধ প্রবেশের মধ্যে ছিল বন বিভাগের টহল এবং পর্যটন। অবৈধ অনুপ্রবেশের মধ্যে মাছ ধরতে ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ, কাঁকড়া ধরতে ৩৭ দশমিক ২০ শতাংশ, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং গোলপাতা সংগ্রহ করতে ৩ দশমিক ১ শতাংশ প্রবেশ ঘটে।
বনে নৌকা প্রবেশের সময় নৌকার নিবন্ধন সনদ (বিএলসি) দেওয়া হয়। নৌকার মাথায় চিহ্ন দিয়ে তা লেখা থাকে। ক্যামেরা ফাঁদে দেখা গেছে, ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ নৌকারই এ ধরনের বিএলসি নম্বর ছিল না।
দুবাই সাফারির মুখ্য বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রহরী ক্যামেরা বসিয়ে বন রক্ষার প্রচেষ্টাকে শুভ উদ্যোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে একেবারে কোনো ক্ষতিই নেই। এটি সাশ্রয়ী। বন পাহারা দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থসহ নানা ধরনের ঘাটতি বন বিভাগের আছে। সেখানে এই চেষ্টা যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে।