শনির হাওরে 'প্রাণ' আছে

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর রক্ষায় ২২ দিন ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধের কাজ করছেন এলাকার মানুষ। ছবিটি গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা l আনিস মাহমুদ
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর রক্ষায় ২২ দিন ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধের কাজ করছেন এলাকার মানুষ। ছবিটি গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা l আনিস মাহমুদ

হাওর ও নদীবেষ্টিত সুনামগঞ্জ শহর। একদিকে সুরমা নদী, অন্যদিকে হাওর। সুরমায় সেতু হওয়ায় সরাসরি যাতায়াত এপার-ওপারে। নদী পাড়ি দিয়ে এগোলে খরচার হাওর। বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলাজুড়ে এই হাওর নিয়ে কৃষক পরিবারে প্রচলিত আছে নানা প্রবাদ। এর মধ্যে একটি বহুল প্রচলিত, ‘খরচার হাওরের ধান/ সারা বাংলার একবেলার প্রাণ’।
‘প্রাণ’ হারানো খরচার হাওরে শুধু পানি। কিন্তু প্রায় ১৬ কিলোমিটার পথ পেরোনোর পর অবাক হওয়ার পালা। শনির হাওরে এখনো ‘প্রাণ’ আছে। বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকেনি। কাঁচা ধান পাকতে শুরু করেছে। বৈশাখে ধান কাটার মৌসুমে হাওরের চিরচেনা রূপ শনির হাওরপারে। ধান মাড়াইয়ের জন্য খলা তৈরি করছেন কিষানিরা। আর কৃষকেরা ব্যস্ত হাওরপারে দিন কয়েক থাকা-খাওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করতে।
শনির হাওর নাম হলেও কোনো কালে শনির দশা ছিল না। বরং ‘ধানের খনি’ বলে কৃষকমহলে পরিচিত। তাহিরপুরসহ জেলার তিন উপজেলা বিস্তৃত এই হাওর আয়াতনেও সুবিশাল। এবার ২২ হাজার একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুস সালাম বলেন, শনির হাওরে কৃষিজমির একরপ্রতি ফলন ৫০ মণ। এ রকম অধিক ফলনের কৃষিজমির হাওর জেলায় দ্বিতীয়টি নেই।
গত ৩০ মার্চ থেকে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে একের পর এক হাওরে পানি ঢুকে ফসল তলিয়ে যায়। সুনামগঞ্জ জেলায় এ বছর ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। প্রশাসন বলছে, ৮২ শতাংশ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কৃষকেরা বলছেন ৯০ শতাংশ। এ অবস্থায় শনির হাওর রক্ষা পাওয়ার খবরটি এ অঞ্চলে বেশ আলোচিত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, সুনামগঞ্জের ৪২টি ফসলি হাওরে ফসল রক্ষায় দেড় হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ঠিকাদার ও স্থানীয়ভাবে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁধ মেরামত ও নির্মাণের কাজ করা হয়েছে। চৈত্র মাসের বৃষ্টিতে (৩০ মার্চ থেকে) উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে ৪০টি হাওরের কাঁচা ধান পানিতে তলিয়েছে। বাকি আছে শুধু শনির হাওর ও পাশের পাকনার হাওর।
প্রায় সব হাওর যেখানে পানিতে তলিয়ে গেল, তখন কী করে রক্ষা পেল ধানের খনি শনির হাওর? টানা ২২ দিন তিনটি উপজেলার হাওরপারের ৪০ গ্রামের মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে রক্ষা পেয়েছে এই বাঁধ। সবাই তাকিয়ে আছে শনির হাওরের দিকে। সুনামগঞ্জের গহিন হাওরে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে সম্মিলিত চেষ্টা নতুন কিছু নয়, কিন্তু প্রকৃতির কাছে হার মানা ৪০ হাওরের পর একটি হাওর কী করে রক্ষা পেল? কথা হয় শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাছরিন আক্তারের সঙ্গে। বললেন, ‘শনির হাওরের বাঁধ রক্ষা শুধু স্বেচ্ছাশ্রম নয়, শেষ পর্যন্ত ফসল রক্ষা পেলে রীতিমতো প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ জয় বলেই মনে করতে হবে।’
‘বর্ষায় নাও/ হেমন্তে পাও’—হাওর এলাকায় বিড়ম্বিত যাতায়াতব্যবস্থা বোঝাতে লোকমুখে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ। বর্ষা আসেনি, কিন্তু অসময়ে এসেছে পানি। আবার শনির হাওর পুরোটা এখনো ‘শুষ্ককাল’। তাই ‘নাও-পাও’ প্রবাদে ভর করে যেখানে গত ২৯ মার্চ থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে মানুষ খেটে চলেছেন, সেখানটায় গিয়ে হাজির। বুধবার সকাল, দুপুর, বিকেল—এই সময়টুকুর মধ্যে তিন রকমের আবহাওয়া পরিস্থিতি অবলোকন করতে হয়েছে শনির হাওরযাত্রায়। সকালটা ছিল মেঘলা আকাশ, দুপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর বিকেল থেকে সন্ধ্যা ‘আফাল-আউকি’ (হাওরের ঢেউ ও ঝড়)।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের জাদুকাটা নদী আর টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে পাটলাই নদের সংযোগ নদ তাহিরপুরের বৌলাই। পাহাড়ি ঢল নামলে এ নদী উপচে বিভিন্ন হাওরে পানি ঢোকে। শনির হাওরের ফসল রক্ষায় উত্তর দিকের বৌলাই নদের তীরঘেঁষা অংশ ফসলরক্ষা বাঁধ। হাওরের ভেতরে সবুজ ধান, বাঁধের ওপাশে ‘নলতল বাইরা’ (সর্বপ্লাবী বন্যা)। দুই দিকের এ রকম বৈচিত্র্যের মধ্যে বাঁধে বসে শুকনো চিড়া খাচ্ছিলেন শ্রীপুর গ্রামের মোহাম্মদ সোহাগ মিয়া। চার দিন ধরে ফসল রক্ষার চেষ্টায় বাঁধে অন্যদের সঙ্গে আছেন তিনি। হাওরে সাত একর জমি আছে তাঁর। জমির ধান ঘরে তোলার মধ্যে তাঁর বছরব্যাপী জীবন যাপনের পরিকল্পনা। ‘এই ধান না পাইলে তো সব শেষ অইযাইব! এক বছর কিলা চলমু। এর লাগি জানপ্রাণ দিয়া ধান বাঁচাইবার চেষ্টায় খাটছি।’ চিড়া খেতে খেতেই বলছিলেন সোহাগ।
আহম্মকখালী বাঁধ এলাকায় কথা হচ্ছিল সোহাগের সঙ্গে। কথা বলার ফুরসত নেই, তবু কথায় যোগ দিলেন কয়েকজন কৃষক। ক্লান্ত-শ্রান্ত চেহারা তাঁদের। মনের জোরে বলীয়ান দেখাচ্ছিল সবাইকে। বেড়িবাঁধের অন্তত চার কিলোমিটার অংশের ১১টি স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষার কাজ চলছে।
কৃষক সোহাগের মতো তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের মানুষের জমি আছে শনির হাওরে। প্রায় ২২ হাজার একর জমির মধ্যে তাহিরপুরের বাসিন্দা কৃষকের জমি আছে প্রায় ১৬ হাজার একর। তাই খাটুনি বেশি তাহিরপুরের। হাওরের কৃষকের বেশে স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ তদারক করছিলেন তাহিপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামানসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ডের সদস্যরা।
উপজেলা চেয়ারম্যান বললেন, অনেক মানুষের দৈনন্দিন কাজের রুটিন বদলে গেছে। তাঁরও বদলেছে। হাওরের বাঁধে যাচ্ছেন আর কার্যালয়ে বসছেন। উপজেলার ২২টি হাওরের মধ্যে ২১টির ফসলই পানিতে তলিয়ে গেছে। সর্বশেষ এই একটি হাওর রক্ষায় যেন প্রকৃতির সঙ্গে চলছে মানুষের লড়াই। বুধবার ঝড়-বৃষ্টির প্রকৃতি দেখিয়ে কামরুল বলেন, যেখানে এক মুহূর্ত ঠেকানো সম্ভব নয়, সেখানে ২২ দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে ফসল রক্ষার চেষ্টা চলছে। আর একটা সপ্তাহ সময় পেলেই ফসল ঘরে উঠবে।
আহাম্মকখালীর দিকে এগোনোর সময় দেখা গেল নৌকায় করে চলছে মাইকযোগে ছন্দোবদ্ধ এক প্রচারণা। ‘দোকানপাট বন্ধ/ যাইতে হইবে বান্ধ (বাঁধে)...।’ এলাকাবাসীকে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করার কী চমৎকার আহ্বান! তাহিরপুর উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হাফিজউদ্দিন বলেন, প্রতিদিন পালা করে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এসে বাঁধে কাজ করছেন। উপজেলা পরিষদ থেকে বাঁশ, বস্তা ও বালুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাঁরা বাঁধে এসে কাজ করতে পারছেন না, তাঁরা মাইক দিয়ে এ রকম প্রচারণায় অংশ নিয়ে স্বেচ্ছায় কর্মরতদের শক্তি জোগাচ্ছেন।
এর মধ্যে ছুটির দিন গত শুক্রবার মানুষের সঙ্গে বাঁধের কাজে যোগ দিয়েছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তারাও বস্তা মাথায় নিয়ে বাঁধে ফেলছে। কথা হয় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের সাতগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোফাজ্জল হোসেন, নবম শ্রেণির ছাত্র আবদুল বাছিত, সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তাসহুদ আহমদের সঙ্গে। সবার মুখে এক কথা, তারা গৃহস্থ পরিবারের। জমির ধান না পেলে উগার খালি থাকবে। তখন পড়াশোনার খরচ নিয়ে পারিবারিক সংকটে পড়তে হবে। এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তফাজ্জুল হোসেন আরও সংক্ষেপে বললেন, ‘এই ধান তুলতে পারলেই আমরা ধনী। তাই ধানের কোনো বিকল্প নাই।’
তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অংশ ছাড়িয়ে জামালগঞ্জের বেহেলি উপজেলার লালুর গোয়ালা এলাকার বাঁধে গিয়ে দেখা গেল, শত শত পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করছেন একজন মাত্র নারী। কৌতূহল সবেধন নিলমণিকে ঘিরে। তিনি বেহেলি ইউপির সংরক্ষিত ওয়ার্ডের (নম্বর ৭, ৮, ৯) নারী সদস্য মনেছা বেগম। একমাত্র নারী হিসেবে বাঁধে নেমে এভাবে কাজ করার কারণকে তিনি জনপ্রতিনিধির দায় বলে মনে করছেন।
নান্টুখালী বাঁধে কর্মরত কৃষকেরা চিন্তিত। বাঁধের নিচ দিয়ে ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকছে হাওরে। কৃষকদের সঙ্গে উদ্বিগ্ন তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও শনির হাওর উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বোরহান উদ্দিন। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা এলাকার হাজারো মানুষ নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করছি। নাওয়া-খাওয়া নাই, কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এর ঠিকাদারের কোনো খোঁজ নেই। তাদের গাফিলতির কারণেই কৃষকদের এই সর্বনাশ।’
পাউবোর বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যদি জনগণকেই শেষ রক্ষায় নামতে হয়, তাহলে এত টাকা খরচ করার কী দরকার, এমন প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক এখন। উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসন স্বেচ্ছাশ্রমের কাজে যৎসামান্য অর্থের জোগান দিতে পারছে। বাকিগুলো জনপ্রতিনিধি ও অবস্থাসম্পন্ন কৃষকেরাই করছেন। বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। তবে তার আগে একটাই প্রার্থনা, মানুষের চেষ্টায় আর প্রকৃতির কৃপায় শেষ রক্ষা যেন হয়।