ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে শঙ্কা

বাগেরহাটে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ না হতেই বাঁধের কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ঠিকাদার। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার আগেই তাঁদের জোর করে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ টাকা পাবেন কি না, তা নিয়েও তাঁদের শঙ্কা রয়েছে।
সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নের খেগড়াঘাট এলাকার দিনমজুর হান্নান শেখ চার বছর আগে বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন বিলে আট কাঠা জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেন। দুই ছেলে, বড় ছেলের স্ত্রীসহ মোট পাঁচজনের সংসার। এ ঘরের ওপর দিয়েই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। হান্নান শেখের স্ত্রী জয়নূর বেগম বলেন, ‘এই খান থেকে নাকি বাঁধের রাস্তা হবে। কাজ শুরু হইছে। ঘরের পাশে মাটি স্তূপ করে রাখছে। আমাগো তো আর অন্য কোনো জায়গাজমি নাই। সরকার যদি এই জমি নেয়, তাহলে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিবো। তাও তো পাইনি। তালিকায় আমাদের নাম আছে কি না, তাও তো জানিনে। ঘর ভাঙলে পাশে যে কোথাও ঘর করব, সে টাকাও তো এহন নাই।’
দুশ্চিন্তায় ভুগছেন একই এলাকার আনোয়ার পোলট্রি ফার্মের মালিক আনোয়ার হোসেন। দুটি ব্যাংক থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নদীর পাশের বিলের মধ্যে গড়ে তুলেছেন মুরগির খামার। কিছু ঋণ পরিশোধ হলেও এখনো ব্যাংক দুটির কাছে তাঁর দেনা প্রায় আট লাখ টাকা। আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রায় ছয় মাস আগে জেলা প্রশাসন থেকে একটি চিঠি পাই। তাতে বাঁধ নির্মাণের জন্য শুধু খামারটি সরিয়ে নিতে বলা হয়। এরপর আর কোনো নোটিশ পাইনি। কিছুদিন আগে খামারের দুই পাশে বাঁধের কাজ শুরু করা হয়েছে। এখন কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না।’
এ রকম সমস্যায় পড়েছেন জেলার ৩৫/১ ও ৩৫/৩ নম্বর পোল্ডারের (চারদিকে নদীবেষ্টিত এলাকা) বাঁধের পাশে ঘর বা জমি থাকা অধিকাংশ মানুষ। ৩৫/১ নম্বর পোল্ডারটি পড়েছে মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলায়। বাঁধের দৈর্ঘ্য ৬৩ কিলোমিটার। আর বাগেরহাট সদর ও রামপাল উপজেলায় অবস্থিত ৩৫/৩ নম্বর পোল্ডারের দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি-১) আওতায় ওই পোল্ডার দুটির বাঁধ উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ করছে পাউবো। এ জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দ্য ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো অব হেনান ওয়াটার কনজারভেন্সি নামের একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। ৪৫৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৯ সাল পর্যন্ত।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ৩৫/১ নম্বর পোল্ডারের আওতায় ৯ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ জন্য নতুন করে প্রায় ৭৪ দশমিক ৫২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। আর ৩৫/৩ নম্বর পোল্ডারের আওতায় নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে ১১ কিলোমিটার। এ জন্য ৪২৫টি দাগে নতুন করে ৬১ দশমিক ২৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে।
সিইআইপি-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল হান্নান বলেন, এটি অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প। এ কারণে বাঁধ নির্মাণ ও জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম একই সঙ্গে চলছে। তবে জমি অধিগ্রহণের কাজ করছে জেলা প্রশাসন। এ কাজের জন্য গত বছরের মাঝামাঝিতে তাদের প্রায় ৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ৩৫/৩ পোল্ডারে জমি অধিগ্রহণের জন্য মালিকদের ৩ ধারা (প্রাথমিক নোটিশ) করা হয়েছে। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে ৭ ধারার (ক্ষতিপূর্ণের অর্থ পরিশোধ) প্রক্রিয়া চলছে। আর ৩৫/১ পোল্ডারে কেবল ৩ ধারার নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম চাপরাশি সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণের জন্য আমাদের ১০ কাঠা জমি নিয়েছে সরকার। তবে এখনো আমরা ক্ষতিপূরণের কোনো টাকা পাইনি’।
সাউথখালী গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন শাহ্ বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। নদীর পাড়ে থাকি, নদীতে মাছ ধরেই জীবন চলে। বাপ-দাদার ভিটার অনেকটাই খাইছে বলেশ্বর নদী। এখন সামান্য যা আছে তা থেকেও বাঁধের জন্য জমি নিচ্ছে সরকার। আমি, আমার ভাই দেলোয়ার হোসেন, চাচা হালিম শাহের ঘর ও জমি গেছে বাঁধে। সেই জমিতে বাঁধের কাজও শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এখনো ক্ষতিপূরণের কোনো টাকা পাইনি। কবে পাব, তাও জানি না।’
জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের পরই কাজ করা উচিত। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের আগেই চায়নিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চলে এসেছে। তারা জমি অধিগ্রহণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নয়। এ কারণে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে। তবে আমাদেরও জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।’
এদিকে, বাঁধ নির্মাণের জন্য মাটি কিনে নেওয়ার কথা থাকলেও জোর করে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক ব্যক্তি বলেন, জমির মালিকদের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে ইচ্ছেমতো মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। আপত্তি জানালে নামমাত্র টাকা দেওয়া হচ্ছে। গভীর খাল হয়ে যাওয়ায় ওই জমিতে চাষ করা যাবে না। এর নেপথ্যে রয়েছেন ডেমা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মনি মল্লিক। তবে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যারা বাঁধের কাজ করছে, তারাই ব্যক্তিমালিকানার জমি থেকে মাটি কাটছে। এতে তাঁর কোনো হাত নেই। তবে যাঁদের জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে, তাঁরা জমির দলিল দেখাতে পারলে তাঁদের টাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
এ প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রয়েল হাসকোনিংয়ের উপ-আবাসিক প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান খান বলেন, যেখানে জমি অধিগ্রহণ করা এখনো শেষ হয়নি, সেখানে বাঁধের কাজ হচ্ছে না। কাজ করলেও, অভিযোগ পেলে তা বন্ধ রাখা হচ্ছে। এখন মূল কাজ হচ্ছে পুরোনো বাঁধ সংস্কার করা ও বিভিন্ন এলাকার পুরোনো স্লুইস গেট নতুনভাবে তৈরি করা। বাঁধের জন্য মাটি নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, মাটির দায়িত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তারা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থেকে মালিকের সঙ্গে চুক্তি করে মাটি নেবে। মাটি নেওয়ার ব্যাপারে এখনো তাঁদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি।
এ ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।