বৃষ্টিতে আবার ডুবল চট্টগ্রাম

সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাওবা পানির উচ্চতা তারও বেশি। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে গতকাল সকালে তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন সড়ক। রাস্তায় বের হওয়া মানুষকে পানি ঠেলেই চলতে হয়েছে। ছবিটি সকাল সাড়ে ১০টায় নগরের ২ নম্বর গেট এলাকা থেকে তোলা l জুয়েল শীল
সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাওবা পানির উচ্চতা তারও বেশি। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে গতকাল সকালে তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন সড়ক। রাস্তায় বের হওয়া মানুষকে পানি ঠেলেই চলতে হয়েছে। ছবিটি সকাল সাড়ে ১০টায় নগরের ২ নম্বর গেট এলাকা থেকে তোলা l জুয়েল শীল

দুই বছর আগে এই এপ্রিল মাসেই চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। তাঁর অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল নগরের জলাবদ্ধতা দূর করা। দুই বছর পর এই এপ্রিল মাসের প্রথম তিন সপ্তাহেই দুবার থইথই জলে ভাসল চট্টগ্রাম। গতকাল শুক্রবার (২১ এপ্রিল) সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে নগরের কোথাও হাঁটুপানি কোথাও কোমরসমান পানিতে তলিয়ে যায়।

এর আগে ৪ এপ্রিলের বৃষ্টিতে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতার কারণে চরম ভোগান্তির শিকার হয় মানুষ। সেদিন ৫৮ মিলিমিটার (সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত) বৃষ্টিতেই অচল হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের জনজীবন। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ছয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৭৮ মিলিমিটার। স্বভাবতই দুর্ভোগের মাত্রাও এবার বেশি ছিল।

বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে সড়ক। ছবিটি গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় চট্টগ্রাম নগরের প্রবর্তক মোড় এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো
বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে সড়ক। ছবিটি গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় চট্টগ্রাম নগরের প্রবর্তক মোড় এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো

নগরের বিভিন্ন সড়ক, অলিগলি, কাঁচাবাজার, ঘরবাড়িতেও পানি ঢুকেছে গতকাল। পানির মধ্যে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। তবে সাপ্তাহিক ছুটির কারণে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় রাস্তায় কর্মব্যস্ত দিনের মতো হাজার হাজার মানুষ ছিল না। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে স্বস্তি বলতে এতটুকুই! বর্ষা আসার আগেই জলাবদ্ধতার ভোগান্তি শুরু হওয়ায় গতকাল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী অনেক মানুষ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন যানবাহনের চালক, পথচারী ও ব্যবসায়ী।

নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বছরে (২০১৫-১৬ অর্থবছর) মেয়র নাছির জলাবদ্ধতা নিরসনে খরচ করেছেন ২০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সাড়ে ১১ কোটি টাকার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে বলে সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়। এতে মানুষের দুর্ভোগের হেরফের হয়নি। বরং অল্প বৃষ্টিতেও এখন নালা-নর্দমা উপচে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে সড়ক।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার বৃষ্টির সময় নদীতে জোয়ার ছিল, তাই পানি দ্রুত সরতে পারেনি। এ কারণেই জলাবদ্ধতা হয়েছে। বৃষ্টি থামার সঙ্গে সঙ্গে পানি বেশির ভাগ এলাকা থেকে সরে যায় বলে দাবি করেন তিনি।

গতকাল সকাল সোয়া নয়টায় ষোলশহর মোড়ে রাস্তায় জলাবদ্ধতার কারণে অন্য গাড়ির সঙ্গে আটকা পড়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স। ভেতরে ছিলেন শ্বাসকষ্টের রোগী নূর বানু (৫০)। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে যাচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্সটি। অ্যাম্বুলেন্সচালক সুদীপ নাথ বলেন, দেড় ঘণ্টা ধরে তাঁরা আটকে আছেন। নিরুপায় হয়ে রোগীকে রিকশায় করে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। পরে নূর বানুর স্বামী মো. আলী অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে রিকশা ভাড়া করেন।

বৃষ্টিতে নগরের মুরাদপুর, ষোলশহর, প্রবর্তক মোড়, জিইসি, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, হেমসেন লেন, হালিশহর, বাকলিয়া, চকবাজার, আগ্রাবাদ, শুলকবহর, কাপাসগোলা, সিডিএ আবাসিক এলাকা, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন স্থানে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি হয়। পানি ঢুকেছে সিডিএ আবাসিক এলাকা, কাপাসগোলা, হেমসেন লেনসহ বিভিন্ন এলাকার বাসার নিচতলায়। প্রবর্তক মোড়ে রাস্তার পাশের বেশির ভাগ দোকানে পানি ঢোকে।

সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ঘরে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পানি ছিল। ঝড়ে এলাকার ১৬ নম্বর সড়কের ওপর বড় একটি গাছ ভেঙে পড়ায় যান চলাচলও বন্ধ ছিল কয়েক ঘণ্টা।

সকালের দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতেই চকবাজার কাঁচাবাজার পানিতে তলিয়ে যায়। সকাল সাড়ে ১০টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পানিতে ভাসছে বিভিন্ন সবজি। আবুল কালাম ও ইসহাক নামের দুই ব্যবসায়ী বলেন, শুক্রবার সকালে কাঁচাবাজারে লোক বেশি থাকে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সব ভেস্তে গেছে। অনেক সবজি পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।

বহদ্দারহাট থেকে জিইসি পর্যন্ত নগরের অন্যতম প্রধান সড়ক সিডিএ অ্যাভিনিউয়ের বিভিন্ন স্থানে পানি ওঠায় সকাল নয়টা থেকে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সকাল ১০টায় জিইসি মোড় এলাকায় কথা হয় কামাল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি কাজে বহদ্দারহাট যাওয়ার জন্য আগ্রাবাদের বাসা থেকে বের হন। কিন্তু জিইসি এসে পানির কারণে অটোরিকশা চলছে না।

ডুবে থাকা সড়কের খানাখন্দে পড়ে সকালে বেশ কয়েকটি রিকশা উল্টে যায়। এ ছাড়া পানিতে আটকা পড়ে নষ্ট হয়েছে বেশ কিছু অটোরিকশা।

সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি মো. মহিউদ্দিন বলেন, পানির কারণে গতকাল রাস্তায় এমনিতেই অনেক কম গাড়ি বের হয়েছে।

বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে রাস্তায় বাস চলেছে কম। এ সুযোগে অনেক রিকশাচালক যাত্রীদের কাছ থেকে স্বাভাবিকের দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করেছেন। প্রবর্তক মোড়ে বেলা ১১টায় এক রিকশাচালক বলেন, ভাই, শুধু প্রবর্তক মোড় থেকে ২ নম্বর গেট পর্যন্ত তিনি যাত্রী আনা-নেওয়া করেছেন। স্বাভাবিক সময়ে এই পথের ভাড়া সর্বোচ্চ ১৫ টাকা। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে তিনি নিয়েছেন ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।

পতেঙ্গা আবহাওয়া দপ্তরের আবহাওয়াবিদ শেখ ফরিদ আহম্মদ বলেন, শনিবারও (আজ) বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ধসের আশঙ্কাও রয়েছে।

মেয়রের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি: ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে আ জ ম নাছিরের প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল পানি নিষ্কাশনের জন্য নগরের খাল-নালাগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, নতুন খাল খনন করা। ১৯৯৫ সালের নগর মহাপরিকল্পনার সময়োপযোগী নবায়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব বলে ইশতেহারে তিনি উল্লেখ করেছিলেন।

নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, নিয়মিত নালা ও নর্দমা পরিষ্কার করা ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় কোনো উদ্যোগ গত দুই বছরে সিটি করপোরেশন নেয়নি।

গতকাল জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে মেয়র নাছির নগরের প্রবর্তক মোড়, চকবাজার, বিমানবন্দর সড়ক, বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় মেয়র তাঁর সঙ্গে থাকা প্রকৌশলীদের এসব এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন।

কেন বারবার বৃষ্টিতে ডুবছে চট্টগ্রাম, এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত বলেন, খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে মূলত জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এগুলোর বিশদ কারণ অনুসন্ধান করে মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা দরকার। কিন্তু চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কিংবা সিটি করপোরেশন কেউ বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয় না।