আর্সেনিক মোকাবিলায় মসুর ডাল!

প্রবাদ আছে, বিষে বিষ ক্ষয় হয়। আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে এমন পথেই হাঁটছেন কিছু বিজ্ঞানী। তাঁরা সেলেনিয়ামযুক্ত মসুর ডাল ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া নিরসনে কাজ করছেন।
আর্সেনিকের মতো সেলেনিয়ামও রাসায়নিক মৌল। দুটোই প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, সহনশীল মাত্রায় তা প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর নয়। কেবল মাত্রারিক্ত হলেই মৌল দুটো বিষক্রিয়ার কারণ হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা কানাডা থেকে এই বিশেষ ডাল এনেছেন।
সেলেনিয়ামযুক্ত মসুর ডাল ওষুধ হিসেবে প্রয়োগের বিষয়ে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলায় একটি গবেষণা বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। এই গবেষণায় সহায়তা করছেন কানাডার ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী।
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা সেলেনিয়াম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ২০১৫ সালের নভেম্বরে, শেষ হয় পরের বছরের নভেম্বরে। এই গবেষণায় দীর্ঘদিন আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ৮০টি পরিবারের ৪০০ সদস্যকে উচ্চমাত্রায় সেলেনিয়ামযুক্ত মসুর ডাল খাওয়ানো হয়।
গবেষক দলের প্রধান আইসিডিডিআরবির নিউট্রেশনাল বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবের প্রধান ড. রুবহানা রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণার মাঠপর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। মাঠ থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা ও তথ্য বিশ্লেষণের কাজ চলছে। এ বছরের শেষ নাগাদ গবেষণা প্রতিবেদন চূড়ান্ত হবে।
সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলেন, পানি বা খাদ্যের সঙ্গে থাকা আর্সেনিক শরীরে জমা হয়। এই আর্সেনিক সহনশীল মাত্রায় ছড়িয়ে গেলে বিষক্রিয়া দেখা দেয়, একপর্যায়ে ক্যানসার হয়। কিন্তু আর্সেনিকের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে সেলেনিয়াম যে নতুন যৌগ (সেলিনো বিস আর্সেনো মিথাইওনাইন) তৈরি করে, তা শরীরে জমা হতে পারে না। ওই যৌগ প্রস্রাব বা পায়খানার সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
শাহরাস্তি উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের রাশেদা সেলেনিয়াম-সমৃদ্ধ ডাল ব্যবহার করে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া কমানোর এই গবেষণা প্রকল্পের একজন মাঠকর্মী। তিনি নিজেও আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। রাশেদার সঙ্গে কথা হয় তাঁর বাড়িতে। রাশেদা বলেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের অন্য চার সদস্য নিয়মিত ওষুধ হিসেবে এই ডাল খেয়েছেন। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। এই ডাল খেতে বেশি স্বাদ ও তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয় বলে জানান রাশেদা।
একই গ্রামের রোজিনা ও তাহমিনা দুই জা। তাঁরাও নিয়মিত এই মসুর ডাল খেয়েছেন। তাঁরা বলেন, তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারের নলকূপের পানিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক।
আইসিডিডিআরবির সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলেন, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে দৈনিক ৬৫ গ্রাম করে টানা ছয় মাস মসুর ডাল খেয়েছেন। ট্রায়াল শুরুর আগে তাঁদের প্রত্যেকের রক্ত, প্রস্রাব, পায়খানা ও চুলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ডাল খাওয়ানো শুরু করার তিন মাস পর আবার প্রত্যেকের এসব নমুনা সংগ্রহ হয়। ছয় মাস পূর্ণ হলে আবারও তা সংগ্রহ করা হয়।
ডালে কী আছে
এই গবেষণায় জড়িত কানাডার ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ইকোসিস্টেম অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক জুডিথ স্মিথ গত বছর প্রথম আলোর যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, কানাডার সাস্কেচুয়ান প্রদেশের পাহাড়ি এলাকার মাটিতে সেলেনিয়ামের পরিমাণ বেশি। এই মাটিতে যে ডাল উৎপাদিত হয়, তাতেও সেলেনিয়ামের পরিমাণ বেশি।
আর্সেনিক ও সেলেনিয়ামের সম্পর্কের বিষয়ে জুডিথ স্মিথ বলেন, সাস্কেচুয়ান অঞ্চলের কোনো কোনো গাছে অতি উচ্চমাত্রায় সেলেনিয়াম রয়েছে। যেসব গবাদিপশু সেই গাছের পাতা খেয়ে সেলেনিয়ামের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, তাদের চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় আর্সেনিক ব্যবহার করা হয়। গত শতকের সত্তরের দশকে গবাদিপশুর ক্ষেত্রে সেলেনিয়ামের বিষক্রিয়া নিরাময়ের জন্য আর্সেনিক ব্যবহার করা হতো। সেই সূত্র ধরে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া নিরসনে সেলেনিয়াম ব্যবহার করা হচ্ছে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে সেলেনিয়ামের কার্যকারিতা নিয়েই বর্তমান গবেষণা।
রুবহানা রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, এই ডালে উচ্চমাত্রায় সেলেনিয়াম আছে ঠিকই, তবে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাত্রায় নয়। ঔষধ প্রশাসনসহ একাধিক সরকারি দপ্তরকে অবহিত করার পর অনুমতি নিয়ে এই ডাল ব্যবহার করা হচ্ছে।
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, জুডিথ স্মিথ ও তাঁর কানাডার সহকর্মীরা আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ইঁদুরের ওপর সেলেনিয়ামের কার্যকারিতা নিয়ে একটি (অ্যানিমেল মডেল) গবেষণা করেছেন। সে ক্ষেত্রেও তাঁরা সাস্কেচুয়ান এলাকার সেলেনিয়াম-সমৃদ্ধ মসুর ডাল ব্যবহার করেছেন। তাতে দেখা গেছে, সেলেনিয়াম ব্যবহারে ইঁদুরের আর্সেনিক বিষক্রিয়া কমেছে।