রওশনই বিরোধী দলীয় নেতা?

এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের নেতৃত্বেই জাতীয় পার্টি (জাপা) সংসদে যাবে এবং তিনিই দশম জাতীয় সংসদে সম্ভাব্য বিরোধীদলীয় নেতা। জাপার দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে এ কথা জানিয়েছে।
জানতে চাইলে জাপার সভাপতি-মণ্ডলীর সদস্য ও নবনির্বাচিত সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ তা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, রওশন এরশাদই বিরোধীদলীয় নেতা হবেন। নির্বাচন বর্জনসহ নানা কারণে স্যার (এইচ এম এরশাদ) বিরোধী দলীয় নেতা হবেন বলে মনে হয় না। আমরাও তাঁকে চাপ দেব না।’
তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাপার প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন, এমন একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, নির্বাচিত সব দলের অংশগ্রহণে এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐকমত্যের’ সরকার গঠনেরও সম্ভাবনা রয়েছে। তেমনটা হলে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের প্রথাগত ভূমিকায় জাপাকে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা কম। গতকাল গণভবনে নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সবাইকে নিয়ে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জাপার নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রধান বিরোধী দল হব। তবে যেহেতু জাতীয় ঐকমত্যের সরকার হবে, সে কারণে আগের মতো সে অর্থে বিরোধী দল থাকছে না। এবার সংসদে একটু ভিন্ন ধাঁচের বিরোধী দল হবে।’
ভিন্ন ধাঁচের বিরোধী দলের ভূমিকা কেমন হবে—এ প্রশ্নের জবাবে ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমরা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করব। ভালো কাজের সমর্থন দেব।’
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ ১৩ জন জয়ী হয়েছেন। এর আগে দলটির ২০ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতানো হয়। সব মিলিয়ে ৩৩ জন সাংসদ দলটির। এ অবস্থায় দশম সংসদে আওয়ামী লীগের পর জাপাই দ্বিতীয় বৃহত্তম দল।
এদিকে জাপার মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, নির্বাচনে জাপার যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁরা শপথ নেবেন কি না, বা জাপা প্রধান বিরোধী দল হবে কি না, এ বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত দলে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। দলীয়প্রধান এরশাদ যা বলবেন, তা-ই হবে।
এরশাদের অনুগত হিসেবে পরিচিত রুহুল আমিন হাওলাদার পটুয়াখালী-১ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর দাবি, তিনি নির্বাচনে জেতার জন্য কোনো কাজই করেননি। কেবল নির্বাচনের আগে এলাকায় গিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করতে।
এইচ এম এরশাদ গত ৩ ডিসেম্বর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে পরদিন দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি ১২ ডিসেম্বর জাপার দলীয় প্রতীক ‘লাঙ্গল’ কাউকে বরাদ্দ না দিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখেন। ওই রাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) ভর্তি করে। এরপর গত ২৫ দিন ধরে তিনি সেখানে আছেন।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এরশাদ ভালো আছেন, গলফ খেলছেন, অসুস্থ হয়েছিলেন, চিকিৎসা চলছে। এর আগে জাপার নেতারা অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায় এরশাদকে চিকিৎসার নামে সিএমএইচে আটকে রাখা হয়েছে।
অবশ্য সরকার অনেক আগেই বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের আয়োজন এবং সে নির্বাচনে জাপাকে সঙ্গে রাখা ও এরশাদকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদলীয় নেতা করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু শেষ দিকে এসে এরশাদ বেঁকে বসায় পাল্টা কৌশল নিতে হয় সরকারকে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাপার একটি অংশকে নির্বাচনে ধরে রাখা হয়। এ জন্য নির্বাচনের আগেই রওশনসহ জাপার ২০ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করানো হয়। এ ছাড়া দলটির প্রার্থীদের মনোনয়ন বহাল রাখাসহ নানা ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হয়।
এরশাদ নিজে তিনটি আসনে (ঢাকা-১৭, রংপুর-৩, লালমনিরহাট-১) জমা দেওয়া মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। তাঁর ভাই ও জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জি এম কাদেরও লালমনিরহাট-৩ আসন থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন। এর মধ্যে কেবল এরশাদের ঢাকা-১৭ আসনের আবেদনটি গৃহীত হলেও অন্য দুটি এবং জি এম কাদেরের মনোনয়নপত্র গৃহীত হয়নি। মনোনয়নপত্র বহাল থাকলেও তাঁরা নির্বাচনে কোনো তৎপরতা চালাননি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, এরশাদ লালমরিহাট-১ আসনে হেরে গেলেও রংপুর-৩ আসনে জয়ী হয়েছেন। আর জি এম কাদেরকে পরাজিত দেখানো হয়। এ অবস্থায় এরশাদ সাংসদ হিসেবে শপথ নেবেন কি না, বা তাঁকে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তা গ্রহণ করবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জাপার কোনো কোনো নেতা এ-ও মনে করেন, সরকার চাইলে শপথের আগেই এরশাদের ওপর আরও চাপ তৈরি করতে পারবে। কারণ এরশাদের বিরুদ্ধে থাকা রাডার ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলাটির আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের ধার্য তারিখ ৯ জানুয়ারি। আর, মঞ্জুর হত্যা মামলার অধিকতর যুক্তিতর্ক শুনানির ধার্য তারিখ ২২ জানুয়ারি।