নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে সবার কথাই শোনা হোক

বাজেট ঘোষণার ঠিক আগ মুহূর্তে এসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বুধবার নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন সংশোধনের কথা বললেন। মূসক (যা ভ্যাট নামেই বহুল পরিচিত) হার কমানোর ইঙ্গিতও দিলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মধ্যকার টানাপোড়েনের আপাত অবসান হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অথচ দুই সপ্তাহ আগেও অর্থমন্ত্রী ছিলেন অনড়। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যাওয়ার ঠিক আগে গত ১৭ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি বৈঠক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি সে সময় আইনের সামান্যতম সংশোধনের কথাও নাকচ করে দিয়েছিলেন। এরপরে গত ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত যৌথ পরামর্শ কমিটির বৈঠকে তো হুমকি-পাল্টাহুমকি দুটোই হলো। দেশের ইতিহাসে বাজেটের আগে এ রকম ঘটনা আর দেখা যায়নি। এ রকম এক মুখোমুখি অবস্থানে থেকেও শেষ পর্যন্ত সরে আসার কথা জানালেন অর্থমন্ত্রী। এমনকি নতুন ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। তা করা হলে এটি হবে বড় ধরনের পরিবর্তন।
ঠিক এক বছর আগেও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন মূসক আইন বাস্তবায়ন নিয়ে অনড় ছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে শেষ মুহূর্তে এসে তা এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য কঠোর অবস্থান থেকে এভাবে সরে আসার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের প্রবল আন্দোলনের সময়েও এমনটি ঘটেছিল।
একদম শেষ সময়ে এসে কঠোর অবস্থান থেকে এই সরে আসার রহস্য অবশ্য সবারই জানা। সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশেই এমনটি ঘটে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরামর্শ বা নির্দেশেই এখন নতুন মূসক আইন সংশোধন হচ্ছে। সরকার পরিচালনা কাঠামোতে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থাকলেও সব সিদ্ধান্ত হয় এক স্থান থেকেই। ফলে মন্ত্রী বা সচিবের কঠোর অবস্থানও রাতারাতি পাল্টে যায়। এর আগের মুখোমুখি অবস্থান বা জেদ—কোনোটাই আর থাকে না। কিন্তু এসব করতে করতে অনেকখানি সময় চলে যায়, আন্দোলন হয়, হুমকি-পাল্টাহুমকি দেওয়া হয়। তাতে হয়রানি বাড়ে, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ক্ষতি হয় অর্থনীতির। আর ব্যবসায়ীরাও জানেন সিদ্ধান্ত কোথায় ও কীভাবে হয়। তাই তো ৩০ এপ্রিলের যৌথ পরামর্শ কমিটির সভায় এত হট্টগোলের পরেও ব্যবসায়ী নেতারা সমাপনী বক্তৃতায় বলেছিলেন যে এই আলোচনার টেবিলে ঠিক না হোক, আরেক টেবিলে ঠিক হবে। শেষ পর্যন্ত তা-ই হচ্ছে।
নতুন এই মূসক আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে সময় লাগে ১৮ মাস। তবে খসড়া পর্যায় থেকেই ব্যবসায়ীরা প্রস্তাবিত আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করতে থাকেন। তখন খসড়া পর্যালোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে প্রধান করে সরকার একটি কমিটি করে দেয়। কিন্তু ২০১৪ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই অর্থমন্ত্রীকে এনে মূসক আইন নিয়ে একটি বৈঠক করে। সেখানে এফবিসিসিআই অভিযোগ করে যে বারবার বৈঠক হলেও তাদের কোনো সুপারিশই গ্রহণ করা হয়নি। এরপরই অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে এনবিআর ও এফবিসিসিআই প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মূসক আইন পর্যালোচনার জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। সেই কমিটি এখন পর্যন্ত ১৮টি বৈঠক করে সাতটি বিষয়ে সংশোধনের জন্য একমত হয়। কিন্তু এফবিসিসিআই বলছে, একমত হয়েও মাত্র একটি বিষয়ের কিছু অংশ গ্রহণ করা হয়। এর বাইরে আর কিছুই গ্রহণ করা হয়নি। যেমন, এফবিসিসিআইয়ের সুপারিশ ছিল মূসকমুক্ত লেনদেনসীমা ২৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লাখ করা। সেটি ৩০ লাখ করা হবে বলে ঠিক করা হয়। গত ৩০ এপ্রিলের পরামর্শ কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ১৮টি বৈঠক করে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হয়নি।
অথচ নতুন মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ বাস্তবায়নের কাজটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হলেও এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক সরাসরি। আইনটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য দুই পক্ষের সক্ষমতা অর্জন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্যবসায়ীরা নিজেরাই বলছেন যে তাঁরা প্রস্তুত নন। আবার এনবিআরের সক্ষমতা নিয়েও আছে প্রশ্ন। এটা ঠিক যে নতুন মূসক আইন বিদ্যমান আইনটির চেয়ে ভালো। আর ব্যবসায়ীরাও বলছেন, নতুন আইনটি বড় ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি ভালো হয়েছে। কিন্তু ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যা তৈরি করবে। হিসাব সংরক্ষণ এর মধ্যে একটি বড় সমস্যা। সুতরাং সব দিক থেকে প্রস্তুত হয়ে আইনটি কার্যকর করাই হবে সবার জন্য ভালো।
এ ছাড়া আরেকটি বিবেচনা আছে। ১৯৯১ সালেও বিরোধিতার মুখে দেশে প্রথম মূসক আইন কার্যকর হলেও ওই বছরটি ছিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রথম বছর। আমরা সবাই জানি সংস্কার বা নতুন কিছু সরকার গঠনের শুরুতে করতে হয়। কেননা, মেয়াদের শেষ দিকে নানা ধরনের বিবেচনা কাজ করে। নির্বাচনী ভাবনায় জনপ্রিয় পদক্ষেপের দিকে সরকার মনোযোগী হয়। এ জন্য বাজেট একটি মোক্ষম অস্ত্র। আর ঠিক এ সময়েই নতুন মূসক আইন বাস্তবায়নের সময় ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আদায় হলেও তাঁরা কেউ নিজের পকেট থেকে মূসক দেবেন না। দেবেন ভোক্তারা। নতুন আইনে ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। এতে সৃষ্টি হবে মূল্যস্ফীতি। সুতরাং যে আইন ব্যবসায়ীদের খুশি করবে না, চাপ বাড়াবে সাধারণ মানুষের ওপর—তা বাস্তবায়ন করা কোনো সরকারের পক্ষেই সহজ নয়।
এবার একটু পেছনে যাওয়া যাক। আইনটি পাস হয়েছিল ২০১২ সালে। মূলত দাতা সংস্থা আইএমএফের শর্ত মেনেই নতুন এই আইনটি করা হয়েছিল। সে সময় আইএমএফের দেওয়া ১০০ কোটি ডলারের বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ) কর্মসূচির আওতায় ছিল বাংলাদেশ। আইনের খসড়া তৈরিতে কারিগরি সহায়তাও দেয় তারা। এমনকি খসড়ার একটি অংশ তাদেরই করে দেওয়া। ২০১৩ সালে প্রকাশিত আইএমএফের প্রতিবেদনেও এ কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি হচ্ছে ২০১৬ সালে নতুন আইনটি বাস্তবায়ন হবে। এই প্রতিশ্রুতি মেনেই কিন্তু অর্থমন্ত্রী আইনটি গত বছরই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু করতে পারেননি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু আছে এমন আইনের খসড়া করা খুবই সহজ। গুগলের কল্যাণে এখন বিভিন্ন আইন সহজেই পাওয়া যায়। কাজ শুধু ভালো ভালো অংশগুলো এনে যুক্ত করা। অবশ্য ইংরেজিতে এর সুন্দর একটা নাম আছে। সেটা হলো‘ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট প্র্যাকটিস’। জানা যায়, নতুন মূসক আইনটিও করা হয়েছিল এই পদ্ধতিতে। ফলে উন্নত বিশ্বের উপযোগী অনেক ভালো ভালো ধারা আইনে যুক্ত করা হয়। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভালো অনেক কিছু থাকলেও বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না এমন অনেক কিছুই আছে আইনে। আর এখানেই দেখা দেয় বিপত্তি।
শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী আইনটি সংশোধন করবেন বলে গতকাল জানালেন। এই সিদ্ধান্ত আগে নিলে বাজেট তৈরি করা সহজ হতো। এখন পুরো বাজেটের আর্থিক কাঠামো নতুন করে তৈরি করতে হবে। সুতরাং বলা যায় অহেতুক অনড় অবস্থানে সব পক্ষকেই অহেতুক কষ্ট দেওয়া হলো। তবে এখন আশা করব, খোলা মন নিয়েই এরপর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে, সম্মত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হবে। তাতে সব পক্ষেরই লাভ।