নতুন নেতৃত্বকে অযোগ্য প্রমাণ করতে বিশৃঙ্খলা?

রাজশাহীতে বিএনপির নেতৃত্বের পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা চলছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন নেতৃত্বকে অযোগ্য প্রমাণ করতে দলের একটি অংশ পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতেই দুটি প্রতিনিধি সম্মেলনে মারামারি হয়েছে।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। শিগগিরই এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসবে।
দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এত দিন রাজশাহী বিএনপির রাজনীতিতে অনেকটা একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমানের (মিনু)। তিনি সাবেক সাংসদ ও তিনবার রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। তাঁর পাশাপাশি সাবেক সাংসদ নাদিম মোস্তফাও ছিলেন আলোচিত নেতা। নাদিম মোস্তফা গত সাত বছর রাজশাহী জেলা বিএনপির রাজনীতির নেতৃত্বে ছিলেন। এই দুই নেতার মধ্যে মতবিরোধ অনেক পুরোনো। নেতা-কর্মীরাও মিনু-নাদিম গ্রুপে বিভক্ত ছিলেন। সাড়ে চার মাস আগে এই দুজন নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েন।
কেন্দ্র থেকে ঘোষিত রাজশাহী মহানগর ও জেলা কমিটি থেকে মিজানুর রহমান ও নাদিম মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় কমিটিতেও এই দুজন ভালো পদ পাননি। মিজানুর রহমানকে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য, আর নাদিম মোস্তফাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, এই পরিবর্তনের মাধ্যমে আলোচিত দুই নেতা দলে গুরুত্ব হারান।
নতুন কমিটিতে রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি হয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। জেলা কমিটির সভাপতি করা হয় আগের কমিটির সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেনকে। মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শফিকুল হক বহাল থাকলেও জেলার সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন হয়। আগের কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমানকে নতুন সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নেতৃত্বের এই পরিবর্তনে পুরোনো নেতা ও তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। তাঁরা নতুন নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের সঙ্গে একত্র হয় পদবঞ্চিত নেতাদের একটি অংশ। দুই পক্ষ মিলে ‘বিএনপি রক্ষা কমিটি’ নাম দিয়ে দলীয় কার্যালয়ে তালা দিয়েছে। তারা দলীয় কর্মসূচি বর্জন, নেতাদের বাড়ি ঘেরাও, নতুন কমিটি বাতিল চেয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে।
এরই মধ্যে গত ২৭ এপ্রিল রাজশাহী মহানগর ও জেলা যুবদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেখানেও সব নতুন মুখ। পদবঞ্চিত ব্যক্তিরা সংবাদ সম্মেলন ডেকে যুবদলের মহানগর কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এরই মধ্যে গত সোম ও মঙ্গলবার রাজশাহী মহানগর ও জেলা বিএনপির প্রতিনিধি সম্মেলন হয়। দুটি সম্মেলনেই হাঙ্গামা হয়। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান লাঞ্ছিত হন।
জেলা বিএনপির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির ক্ষমতা ব্যবহার করে রাজশাহীতে রাজত্ব করে এসেছেন, দলকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করছেন, খালেদা জিয়ার নির্দেশ অমান্য করছেন, তাঁরাই এই বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছেন।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রিয়। তিনি প্রতিনিধি সম্মেলনে যাননি অসুস্থতা ও মামলার হাজিরার কারণ দেখিয়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা শহরে বসে দলের বড় পদ চান, কিন্তু দলে সক্রিয় নন; পদ না পেয়ে তাঁরাই বিশৃঙ্খলা করেছেন।
রাজশাহী বিএনপির সাবেক একজন প্রভাবশালী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজশাহী মহানগর ও জেলার নতুন কমিটির ওপর নেতা-কর্মীদের আস্থা নেই। নেতাদেরও দলের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে দল অচল হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে মহানগর বিএনপির সভাপতি ও মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে নেতা এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, তিনি একটা ঘরোয়া মিলাদের আয়োজন করতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। বর্তমানে দেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে কোনো থানা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও রাজনীতি করার অধিকার নেই। এ অবস্থার মধ্যেও আমরা ভূমিকা রাখছি।’
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক দলে মিজানুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। গত মঙ্গলবার বিমানবন্দরে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমানের ওপর হামলার জন্য তাঁকে দায়ী করেন দলের কেউ কেউ।
জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, বিএনপি বড় দল, নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি থাকতেই পারে। এটা ঠিক হয়ে যাবে।
রাজশাহীর প্রতিনিধি সম্মেলনে মারামারির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘চট্টগ্রামে বিশৃঙ্খলার ঘটনায় দুজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। রাজশাহীতেও বিশৃঙ্খলাকারীদেরও শনাক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপির প্রতিনিধিদল শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে প্রতিবেদন দেবে। লঘু হোক বা গুরু হোক, বিশৃঙ্খলাকারীদের শাস্তি পেতেই হবে।’