আটকে গেছে অধিগ্রহণ

বগুড়া শহরের নওয়াব বাড়ির দি প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্কে দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। দিনের বেশিভাগ সময় অলস বসে থাকতে হয় কর্মীদের। ছবিটি ৬ মে বেলা ১১টায় তোলা l প্রথম আলো
বগুড়া শহরের নওয়াব বাড়ির দি প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্কে দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। দিনের বেশিভাগ সময় অলস বসে থাকতে হয় কর্মীদের। ছবিটি ৬ মে বেলা ১১টায় তোলা l প্রথম আলো

রেল চলছে না, চরকিও ঘুরছে না। কেটে ফেলা শতাব্দীপ্রাচীন জৈতুনগাছের কাণ্ডের প্রকাণ্ড দুটি টুকরো অবহেলায় পড়ে আছে প্রাসাদের সামনে। রং উঠে গেছে বাঘ, জিরাফ প্রভৃতির। সবকিছুই মলিন, জরাজীর্ণ। আগের জৌলুশ নেই। সুনসান ভৌতিক এক পরিবেশ বিরাজ করছে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী ‘নওয়াব প্যালেস’-এ। দেখে পরিত্যক্তই বলে মনে হয়।

৪ মে বিকেলে ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় দর্শনার্থীশূন্য প্রাসাদের ভেতরে জনাদুয়েক নিরাপত্তারক্ষী চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছেন। জানা গেল, এক বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করেছে। আর প্যালেসের ক্রেতারা মালিকানার দাবিতে আদালতে রিট করেছেন। এ অবস্থায় ঐতিহাসিক এই স্থাপনার ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

নওয়াববাড়িটিকে উত্তরাঞ্চলের একটি অন্যতম আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্র ও জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল গত শতকের আশির দশকের শেষ ভাগে। ওয়াক্ফ এস্টেটভুক্ত এ সম্পত্তির মোতোয়ালি ছিলেন সৈয়দ ওমর আলী চৌধুরী। বগুড়ার স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী আমিনুল করিম দুলাল প্রাসাদের চত্বরে নানাবিধ ভাস্কর্য, চিত্রকলা স্থাপন করে প্যালেসের ফটক, দেয়াল, আসবাবের অলংকরণ ও উদ্যান তৈরির ভেতর দিয়ে নওয়াববাড়িকে দৃষ্টিনন্দন জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলেন। সেই সঙ্গে টয় ট্রেন, চরকিসহ বিভিন্ন রকমের রাইডও স্থাপন করা হয়। নাম রাখা হয় ‘দ্য প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’।

ঢাকায় যেমন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বিখ্যাত আহসান মঞ্জিল ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন এবং ঢাকাবাসীর গর্ব; বগুড়া ও বগুড়াবাসীর কাছে নওয়াববাড়িও তেমন। ব্রিটিশ ভারতের ‘নাইট’ উপাধিপ্রাপ্ত একমাত্র মুসলিম জমিদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব বাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী এবং অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আলীর স্মৃতিবিজড়িত এই নওয়াব প্যালেস ওয়াক্ফ এস্টেট সম্পত্তি হলেও এটিকে ব্যক্তিমালিকানা দেখিয়ে গত বছরের ১৫ এপ্রিল ১ একর ৫৫ শতাংশ জায়গার প্রাসাদটিকে তিন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

নওয়াববাড়ি বিক্রির শুরু থেকেই বগুড়াবাসীর ভেতরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীসহ নাগরিক অধিকারবিষয়ক সংগঠন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা ও বিনোদনকেন্দ্রটিকে সংরক্ষণের দাবি তুলতে থাকেন। এর ফলে নওয়াববাড়ির ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই ‘মোহাম্মদ আলী প্যালেস’ সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। গত বছরের ১২ মে এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এরপরে বগুড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে নওয়াববাড়ির সামনে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ ঘোষণার নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়। পাশেই ক্রয়সূত্রে মালিকানা দাবি করে তিন ক্রেতাও তাঁদের নাম লেখা ডিজিটাল ব্যানার লাগিয়ে রেখেছেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করেই বগুড়ার নওয়াব প্যালেসকে গত বছর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ওই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্যালেসের ক্রেতারা হাইকোর্টে রিট করেছেন। এখন রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এটি অধিগ্রহণ সম্ভব নয়।

প্রাসাদ ক্রেতাদের নিয়োগ করা তত্ত্বাবধায়ক জাহিদুল ইসলাম খান গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আদালতে গত বছর রিট করেছেন। এখন আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে যে সিদ্ধান্ত আসবে, তা তাঁরা মেনে নেবেন। প্যালেসের বিনোদনকেন্দ্র ও জাদুঘর চালু আছে। তবে দর্শনার্থী কমে গেছে বলে পরিচর্যাও কমে গেছে।

কিন্তু প্রাসাদের নতুন ক্রেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে দর্শনার্থীদের নওয়াববাড়িতে আসতে নিরুৎসাহিত করছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্যালেসের প্রবেশ টিকিটের মূল্য ছিল ২০ টাকা। অথচ এখন ভেতরে রাইড বন্ধ। পরিচর্যার অভাবে সব জরাজীর্ণ। কিন্তু প্যালেসের প্রবেশ টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ টাকা। লোকজন যাতে এখানে না আসেন, সে জন্য কৌশল করে টিকিটের দাম বাড়ানো হয়েছে।

বান্ধবীদের সঙ্গে নওয়াববাড়ি ঘুরতে আসা দর্শনার্থী বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের স্নাতক সম্মানের শিক্ষার্থী রেজওয়ানা বীথি বলেন, ‘এক বছর আগেও নওয়াব প্যালেস ছিল জমজমাট। এখন এসে দেখছি, ভেতরে সবকিছুই মলিন। রাইড চলে না। অথচ প্রবেশমূল্যও দ্বিগুণ করা হয়েছে।’ প্যালেস রক্ষা আন্দোলনের নেতা ও জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্রাচীন পুণ্ড্রনগর মহাস্থানগড়ের পরেই নওয়াববাড়ি বগুড়া অঞ্চলের প্রাচীন প্রত্ননিদর্শন। শুধু পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দিলেই হবে না, এটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণেও সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।