ভাইয়ের খুনি স্বামীর প্রথম শ্রেণি চান স্ত্রী!

আসামি যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন, তাঁর এক ভাই সচিবালয়ে পদস্থ কর্মকর্তা, আরেক ভাই এলাকায় চেয়ারম্যান। শ্যালক হত্যার দায়ে সাজা পাওয়া এই আসামির জন্য কারাগারে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা চেয়ে আবেদন করেছেন তাঁর স্ত্রী।

রাজধানীর শান্তিবাগে মিলন হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি হাফিজুর রহমান। তিনি বর্তমানে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, পরকীয়ায় বাধা দেওয়ায় স্ত্রী খালেদা পারভিনকে নির্যাতন করতেন হাফিজুর। খালেদা তাঁর ভাই মিলনকে নির্যাতনের বিষয়টি জানান এবং ২০১২ সালের ২৯ মে তাঁকে বাসায় ডেকে আনেন। ওই দিন হাফিজুর শ্যালক মিলনের সামনেই স্ত্রীকে নির্যাতন করেন। মিলন বাধা দেন। এ নিয়ে হাফিজুরের সঙ্গে মিলনের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে হাফিজুর তাঁর শটগান দিয়ে গুলি করলে মিলন নিহত হন। এ ঘটনায় মিলনের স্ত্রী মেহেরুন নিসা থানায় মামলা করেন।

মামলাটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে একে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়েছিল। শাহজাহানপুর থানা হাফিজুরকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয়। আদালত হাফিজুর রহমান খানকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি হাফিজুর কুমিল্লার চান্দিনার হাবিবুর রহমান টেক্সটাইল মিলসের সাবেক নির্বাহী পরিচালক। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০৭ সালে চাকরিচ্যুত হন। হাফিজুরের নৈতিক স্খলন ছিল। পরকীয়ায় আসক্ত ছিলেন।

ভাই হত্যার দায়ে সাজা পাওয়া স্বামীর জন্য প্রথম শ্রেণির মর্যাদা চেয়ে আবেদনে স্ত্রী খালেদা পারভিন বলেন, ‘আমার স্বামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন জেলে থাকাবস্থায় বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে জেল হাসপাতালে রেখে বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাফিজুর রহমান বর্তমানে জেলের ভেতরে শারীরিক ও মানসিকভাবে করুণ অবস্থায় দিন যাপন করছেন।’ তিনি বিশেষ বিবেচনায় আসামিকে প্রথম শ্রেণির বন্দীর মর্যাদা দেওয়ার অনুরোধ করেন।

আবেদনপত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাংসদ নাজমুল হাসান পাপন, মরহুম মেয়র হানিফ, শিল্পপতি সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আসামির বিভিন্ন ছবি সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। গাজীপুর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই আবেদন পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পরে মন্ত্রণালয় থেকে কারা অধিদপ্তরের মতামত চাওয়া হয়।

কারা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, আশ্চর্যের বিষয়, যে বোনকে বাঁচাতে ভাই প্রাণ দিলেন, সেই বোনই এখন খুনি স্বামীকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

এ ঘটনায় ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করে নিহত মিলনের পরিবারের সদস্যরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে তাঁকে প্রথম শ্রেণির বন্দীর মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে? তাঁর কী যোগ্যতা আছে? শুধু অতিরিক্ত সচিব ও চেয়ারম্যানের ভাই বা তাঁদের চাপে এই মর্যাদা দেওয়া হলে তা অন্যায় হবে।’ তাঁরা বলেন, রায়ের পর তিনি একজন খুনি। তাঁর কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই।

মিলনের পরিবারের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে জানা গেল, হাফিজুর রহমানের এক ভাই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মসিউর রহমান। আরেক ভাই মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার ইমামপুরের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ জিন্না। মসিউর রহমানকে গতকাল রাতে টেলিফোনে পাওয়া গেলেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। আর চেয়ারম্যান মনসুরের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। আর বিষয়টি ব্যক্তিগত।’

কারা শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম শ্রেণির মর্যাদা চেয়ে যে কারও আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে মন্ত্রণালয় জেল কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলে থাকে।

জেল কোড অনুযায়ী কারাবন্দীদের দুই ধরনের মর্যাদা দেওয়া হয়। ভালো চরিত্রের অধিকারী, সামাজিক অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা, উচ্চতর জীবন যাপনে অভ্যস্তদের প্রথম শ্রেণি দেওয়া হয়। তবে নৃশংসতা, নৈতিক স্খলন এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসামূলক অপরাধ, অপরাধ ঘটানোর জন্য অস্ত্র রাখা, হিংস্রতার মতো মারাত্মক অপরাধীরা এই সুবিধা পান না।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জ্যেষ্ঠ জেল সুপার সুব্রত কুমার বালার পাঠানোর মতামতে শুধু আসামির সাজার হিসাব ছিল। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো মতামত দিইনি। শুধু তাঁর তথ্য দিয়েছি।’ তবে তিনি এ-ও বলেছেন, আসামি নিজে বলেছেন তিনি একজন শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী।

প্রথম শ্রেণির বন্দীদের আলাদা কক্ষ, খাট, তোশক, মশারি, টিভি, পত্রিকা ইত্যাদি সুবিধা দেওয়া হয়। খাবারও দেওয়া হয় উন্নতমানের।