জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গুরুত্ব হারাচ্ছে?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলেছে, গত পাঁচ বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার প্রায় স্থবির হয়ে আছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যাও আর বাড়ছে না। দেশের জনসংখ্যার ওপর পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। এক হিসাবে বলা হয়, ২০৫১ সালে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২১ কোটি ৮৪ লাখে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাড়তি জনসংখ্যা কর্মসংস্থান, ভূমি, কৃষি, আবাসন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। অথচ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বছরে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ঢিলেঢালা চলছে।

অবশ্য সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাধীনতার পর থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। প্রজনন হার কমেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হারও বেড়েছে। সেই অগ্রগতি ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

বিবিএস গত সপ্তাহে ‘বাংলাদেশ স্যাম্পেল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৬’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, গত বছরের ১ জুলাই দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি। এ বছর তা বেড়ে ১ জানুয়ারিতে হয়েছে ১৬ কোটি ১৭ লাখ। ৬ মাসে জনসংখ্যা বেড়েছে ১৭ লাখ। অর্থাৎ, দৈনিক জনসংখ্যা বাড়ছে ৯ হাজার ৩১৫ জন।

বাংলাদেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখাতে পেরেছিল জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার (কন্ট্রাসেপটিভ প্রিভিলেন্স রেট-সিপিআর) বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে সক্ষম দম্পতির ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। প্রতি দশকে এর ব্যবহার বেড়েছে। ২০০০ সালে এই হার বেড়ে ৫৮ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপরের ১০ বছরে গতি অনেকটা শ্লথ হয়ে পড়ে। ২০১১ সালে এর হার ছিল ৬১ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ছিল ৬২ দশমিক ৩। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার তেমন বাড়েনি। গত পাঁচ বছরে বেড়েছে মাত্র দশমিক ১ শতাংশ বিন্দু।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের সঙ্গে মোট প্রজনন হারের (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) সম্পর্ক সরাসরি। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারী যত সন্তানের জন্ম দেন, সেটাই টিএফআর। ১৯৭৫ সালে নারীরা মোট ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন (টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৩)। বর্তমানে টিএফআর ২ দশমিক ১। অর্থাৎ গড়ে একজন নারী দুজন করে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন।

এক নম্বর সমস্যা নয়?

স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনসংখ্যাকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বর্তমানে সরকারের প্রশাসন জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে না। তারা মনে করছে, জনসংখ্যার বিষয়ে দেশের মানুষ অনেক সচেতন। জনসংখ্যা তেমন কোনো সমস্যা নয়। বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, বোঝা নয়।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার ধারণা, প্রশাসনের এমন মনোভাব জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. নূর হোসেন তালুকদার ২০১৫ সালের ১৪ মে এক আধা সরকারি পত্রে (ডিও লেটার) বলেছিলেন, ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কাজে কোনো অগ্রগতি নেই, ফলাফল স্থির হয়ে আছে। অথচ প্রতিবছর অধিদপ্তর ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা খরচ করে।

কর্মসূচিতে ধার নেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক অবস্থা, নারীর ক্ষমতায়ন—এসব ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চলছে সনাতন পদ্ধতিতে। এই কর্মসূচি এখন আর মানুষকে আকর্ষণ করে না। কর্মসূচিতে ধার নেই।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পরিবারকল্যাণ সহকারীদের জন্য সারা দেশে অনুমোদিত পদ আছে সাড়ে ২৩ হাজার। বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার পদ শূন্য। এ ছাড়া উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তা, ফার্মাসিস্ট, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকসহ কিছু পদে আরও প্রায় তিন হাজার শূন্য পদ আছে।

অথচন পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে মাঠপর্যায়ে মানুষের ঘরে ঘরে সেবা পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে পরিবারকল্যাণ সহকারীদের বেশ কিছু পদ শূন্য থাকলেও নিয়োগ হচ্ছে না দীর্ঘদিন। এতে মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও চাহিদামতো সক্ষম দম্পতির হাতে তা পৌঁছানো যাচ্ছে না। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ১২ শতাংশ সক্ষম দম্পতি তাঁদের প্রয়োজনমতো জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পাচ্ছেন না।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠসেবা কর্মসূচির ব্যবস্থাপক মো. মাহবুব-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার যে পর্যায়ে আছে, তার থেকে বাড়ানো কঠিন। বরং এটাকে ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ।’ তিনি বলেন, অধিদপ্তর ও সরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন। মাঠপর্যায়ে কর্মিস্বল্পতার কারণে সেবা সরবরাহে কিছু সমস্যা আছে। কর্মসূচি নতুন করে ঢেলে সাজানোর চিন্তাও শুরু হয়েছে।

দীর্ঘস্থায়ী ও স্থায়ী পদ্ধতি (নারী বন্ধ্যাকরণ, পুরুষ বন্ধ্যাকরণ, ইমপ্লান্ট ও আইইউডি) ব্যবহারের হার খুব কম। এই হার বর্তমানে ৮ দশমিক ১ শতাংশ। প্রায় এক দশক ধরে দীর্ঘস্থায়ী ও স্থায়ী পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে, কিন্তু খুব বেশি সফল হওয়া যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের উচিত দীর্ঘস্থায়ী ও স্থায়ী পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া।

পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে

দেশে জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ১৭ লাখ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১০০ মানুষ বাস করে। বাংলাদেশে জনঘনত্ব ভারতের চেয়ে চার গুণ ও চীনের চেয়ে আট গুণ বেশি। একমাত্র নগররাষ্ট্র ছাড়া এত বেশি জনঘনত্বের দেশ আর নেই।

জনসংখ্যার চাপ পড়ছে সমাজ ও অর্থনীতিতে। আবাসন, পরিবহনসহ সব খাতে সংকট বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে ঘটছে বিপর্যয়। রোগীর চাপে হাসপাতালগুলো মানসম্পন্ন সেবা দিতে পারছে না। ২৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়। এর সঙ্গে প্রতিবছর ৩৪ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। জনসংখ্যার এই সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিবিএস ২০১৫ সালে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছিল। তাতে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ২০১৪ সালের প্রাক্কলনের তথ্য ব্যবহার করা হয়। এতে বলা হচ্ছে, ২০৫১ সালে দেশের মানুষ হবে ২১ কোটি ৮৪ লাখ। আর ২০৬১ সালে হবে ২২ কোটি ৫৭ লাখ। এর অর্থ, মানুষ বেড়েই চলবে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির দৃশ্যমান সমস্যা হচ্ছে বেকারত্ব। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে (২০১৫-১৬) বলা হচ্ছে, দেশে কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে বেকার প্রায় ২৬ লাখ। তবে কিছু জনসংখ্যাবিদ মনে করেন, বেকারের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। প্রতিবছর এই বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, কর্মসংস্থান সেই হারে বাড়ছে না।

অন্য এক প্রাক্কলনে বলা হয়েছে, ২০৫১ সালে দেশে প্রতি আটজনের একজন ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী হবেন। মাথাপিছু জমির পরিমাণও কমবে। বর্তমানের ১৫ ডেসিমেলের পরিবর্তে মাথাপিছু জমি কমে ৭-৮ ডেসিমেলে দাঁড়াবে। এতে মাথাপিছু উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কৃষি খাতে অতিরিক্ত শ্রমশক্তি কাজে লাগানো কঠিন হবে। মাথাপিছু জমি কমে যাওয়ার কারণে আবাসন সমস্যা আরও প্রকট হবে। স্বল্প পরিসরে বেশি মানুষ বসবাসের কারণে পানি ও বায়ুদূষণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় প্রয়োজনের তুলনায় কম, সেই ব্যয় আরও কমে যেতে পারে, যা জীবনমানের ওপর প্রভাব ফেলবে।

সার্বিকভাবে অর্থনীতির ওপরও বাড়তি জনসংখ্যা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী। তিনি বলেন, ‘বয়সকাঠামোয় পরিবর্তনের কারণে কর্মক্ষম জনসংখ্যা আমাদের বাড়ছে ঠিকই, তার ইতিবাচক প্রভাব আমরা দেখছি। কিন্তু উচ্চ-মধ্যম বা উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে যে ভালো কাজের (হোয়াইট কলার জব) সুযোগ দরকার, দেশে তার প্রস্তুতি কম।’ তিনি বলেন, বেকারত্ব সমস্যা এখনই প্রকট। ব্যাপকভাবে কাজের সুযোগ সৃষ্টি না হলে বেকার সমস্যা আরও প্রকট হবে এবং তা সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।