সৌদি আরবে প্রবাসী শ্রমিকদের অপরাধ প্রবণতায় উদ্বেগ

মেহেরপুরের বাবু মিয়ার ছেলে আবদুল মিয়া গত বছরের ১৯ নভেম্বর সৌদি আরবের রিয়াদে সেখানকার স্থানীয় পুলিশের হাতে আটক হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানকার কয়েকটি শহরে আবদুল মিয়া আরও কয়েকজন বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও মালয়েশিয়ান নাগরিককে নিয়ে মাদক ব্যবসার একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। একই চক্রের আবু জাফর, ইকবাল আলী, শামীম মোহাম্মদ মাদক ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা পড়ে এখন সৌদি আরবের জেলে। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের পাশাপাশি নানান সংখ্যায় প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের শাস্তিও দেওয়া হয়েছে তাঁদের।

গত বছরের ৭ অক্টোবর রিয়াদে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে আট বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে এক মিসরীয় নাগরিককে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে এক পাকিস্তানি নাগরিককে হত্যার দায়ে এক বাংলাদেশির শিরশ্ছেদের আদেশ দেওয়া হয়। রক্তঋণ (নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সাজা থেকে অব্যাহতি) দিয়ে তিনি রক্ষা পান।

হুন্ডি, জুয়া, চুরি, ডাকাতি ও অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক বাংলাদেশি। গত তিন বছরে নানান অপরাধের দায়ে ২০ হাজার ৩১ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে সৌদি আরব সরকার। সৌদি আরব থেকে এসব জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত ৯ মে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অপরাধপ্রবণতার এই চিত্র পাঠানো হয়েছে। সৌদি আরব জানিয়েছে, প্রবাসীদের মধ্যে অপরাধ সংঘটনে বাংলাদেশিদের স্থান পঞ্চম। ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের অপরাধপ্রবণতার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে।

প্রবাসী শ্রমিকদের অপরাধপ্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসও। বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে আরও সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ জানিয়েছে তারা। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও। মন্ত্রণালয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অপরাধপ্রবণ কোনো বাংলাদেশি কর্মী যাতে সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তাঁরা বলেন, দীর্ঘদিন সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকার পর সৌদি শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু অপরাধপ্রবণতার কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ আবার সংকুচিত হতে পারে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম শামছুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অপরাধীর জন্য বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয় এবং শ্রমবাজারে  প্রভাব পড়ে। সৌদি আরবসহ বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন, তাঁদের সে দেশের আইনকানুন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা প্রশিক্ষণ দেব। এ ছাড়া অপরাধে জড়িত কোনো কর্মী যাতে সৌদি আরবে না যেতে পারেন, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, অপরাধ সংঘটনের দায়ে যেসব বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাঁরা যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ব্যবস্থা নেবে। বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র বা স্মার্ট কার্ড ছাড়া কোনো কর্মী যাতে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময় বাংলাদেশিদের অপরাধ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিই। এরপরও বাংলাদেশিরা চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারি, মানি লন্ডারিং, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার আর খুনের মতো জঘন্য ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। কেউবা দেশে অপরাধের মামলা থেকে বাঁচতে সৌদি আরবে এসে আত্মগোপন করছেন। তাঁদের অপরাধের কারণে সাধারণ শ্রমিকেরা হয়রানি আর বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের শ্রম মন্ত্রণালয়, রিক্রুটিং এজেন্সি এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশি-অধ্যুষিত এলাকা, বিশেষ করে রিয়াদের বাথা, হারা, জেদ্দার বালাদ, দাম্মাদের সিকোতে প্রবাসীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে।

বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্যমতে, দেশটির ১৪টি কারাগারে আটক রয়েছেন ২৮০ জন বাংলাদেশি। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন দূতাবাস ও বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, প্রায় ৪২টি দেশে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি আটক আছেন। মধ্যপ্রাচ্যে রক্তঋণ প্রথা কাজে লাগিয়ে এ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৫ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছে।