বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে যেনতেনভাবে

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও মানের বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি আইন থাকলেও এর প্রয়োগ সেই অর্থে নেই। আইনটি কার্যকরের চেষ্টা, উদ্যোগ বা সামর্থ্যও নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)।

এর বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে প্রায় অর্ধেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য না থাকা। ইউজিসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশের ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৮৯টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে ৪৩টিতে উপাচার্য ও ৫৩টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই। এ ছাড়া সহ-উপাচার্য নেই ৭৫টিতে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় মূল নেতৃত্ব যাঁরা দেন, তাঁদের ছাড়াই চলছে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আনুষ্ঠানিক তথ্য না থাকলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির তথ্য হচ্ছে, ১০ থেকে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে চলছে। বাকিগুলো শর্ত পূরণ ছাড়াই চলছে যেনতেনভাবে। এগুলোর কোনো কোনোটির বিরুদ্ধে শিক্ষার নামে সনদ বিক্রিসহ রয়েছে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম শ্রেণিতে ১০ থেকে ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ২০ থেকে ২৫টি শিক্ষার মান ভালো না হলেও চেষ্টা করছে। বাকিগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার জন্য যে মান থাকার কথা, তা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

ইউজিসির একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

গত ২০ জুন ইউজিসি ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা তুলে ধরে এগুলোতে ভর্তি হওয়ার আগে সতর্কতা জারি করে গণবিজ্ঞপ্তি দেয়। ২৩ জুলাই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার আগে ভর্তি-ইচ্ছুকদের সতর্ক করতে এই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় বলে ইউজিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।

অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণ, মান ও সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করতে না পারলেও সরকার নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় চার লাখ। বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে গত প্রায় ৯ বছরেই ৪১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় আরও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা। সরকারের এই মনোভাব বুঝতে পেরে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সরকারঘনিষ্ঠ অনেকেই জেলা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়েছেন, অনেকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ দেওয়ার মতো ‘উপযুক্ত’ অধ্যাপক পাওয়া যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, এসব পদ শূন্য রেখে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা, আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজ ব্যাহত হয়।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত তিন বছরে এই পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হয়েছে। ২০১৪ সালের মার্চে এ বিষয়ে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তখন ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও ৪৮টিতে কোষাধ্যক্ষ ছিলেন না। এখন সংখ্যাটি আরও বেড়েছে। এখন ৪৩টিতে উপাচার্য ও ৫৩টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই।

 একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং সরেজমিনে জানা গেছে, কেউ কেউ নিয়মনীতি ছাড়াই নিজেদের পছন্দের কাউকে উপাচার্যের চেয়ারে বসিয়ে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ওই সব পদে নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, আচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কোনো কারণে এসব পদ শূন্য হলেও আচার্য কাউকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেন। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন নিজেরাই ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দিচ্ছে, যা আইন ও বিধিবিধানের পরিপন্থী।

ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকেবলেন, বর্তমানে ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেগুলোতে ভালো মানের উপাচার্য দেওয়ার মতো অধ্যাপক পাওয়া যায় না। সম্প্রতি কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে সরকার। এ বছর অন্তত চারটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের উপাচার্যদের পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকেরা চান নিজেদের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের উপাচার্য করতে। এ জন্য তাঁরা এমনভাবে প্রস্তাব পাঠান, যাতে প্রায়ই ত্রুটি থাকে। এ কারণে নিয়োগ দিতে সমস্যা হয়। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উপাচার্যের বেতন-সুবিধা বাবদ কয়েক লাখ টাকা খরচ বাঁচাতেও উপাচার্য নিয়োগে অহেতুক বিলম্ব করে বলেও অভিযোগ আছে। আবার সরকারও কখনো কখনো রাজনৈতিক বিবেচনায় বা পছন্দ না হওয়ায় নিয়োগ দেয় না।

দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটিতে শীর্ষ তিন পদের কোনোটিতেই রাষ্ট্রপতির নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ নেই। সম্প্রতি রাজধানীর আসাদগেট এলাকায় অবস্থিত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলায় ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষে উপাচার্য, রেজিস্ট্রারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দপ্তর। উপাচার্যের চেয়ারে বসে কাজ করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক আরজু মিয়া। তবে রাষ্ট্রপতি তাঁকে নিয়োগ দেননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৬ মে থেকে তিনি এই চেয়ারে বসছেন। তিনি দাবি করেন, এই তিন পদে কেউ না থাকলেও খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।

উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবীর হোসেন মনে করেন, দক্ষ লোকের অভাব এবং নিয়মনীতির কিছু ত্রুটির কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। তিনি সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, এখন এসব পদের প্রতিটির জন্য তিনজনের নাম দিয়ে প্রস্তাব পাঠাতে হয়। কিন্তু ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের জন্য এত দক্ষ অধ্যাপক কি এই সেক্টরে আছেন? একজনকে প্রস্তাব দিয়ে যাতে নিয়োগ পাওয়া যায়, সেভাবে আইন সংশোধনের দাবি জানান তিনি।

ইউজিসির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ জুন পর্যন্ত যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ—এই তিন পদে নিয়মিত কেউ নেই, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, আন্তর্জাতিক ইসলামি ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম, গণবিশ্ববিদ্যালয়, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, বগুড়ার পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়, জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি চট্টগ্রাম, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকা আরও পাঁচটিতে অবশ্য এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ইউনিভার্সিটি, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, আন্তর্জাতিক ইসলামি ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছে, নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

উপাচার্য না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আরও রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশা ইউনিভার্সিটি, ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ফেনী ইউনিভার্সিটি, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এর মধ্যে অবশ্য কয়েকটিতে উপাচার্য নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম আলোকে জানিয়েছে, উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত, এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়াই ঠিক হয়নি। দুর্বল কাঠামোর ওপর অনুমোদন দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন একধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব পদে নিয়োগের জন্য এত অধ্যাপক কোথায় পাবে? তবে এসব পদে নিয়োগ নিয়ে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের মধ্যেও অবহেলা আছে। নিয়মিত উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না বলে মনে করেন বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ।