অনুতাপ থেকেই ভারতীয় শিক্ষার্থী খুন, আত্মহত্যার চেষ্টা?

চট্টগ্রামে নিহত ভারতীয় শিক্ষার্থী আসিফ শেঠ। ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামে নিহত ভারতীয় শিক্ষার্থী আসিফ শেঠ। ছবি: সংগৃহীত

নগরে নিহত ভারতীয় শিক্ষার্থী মো. আতিফ শেখ (২৬) ও আরেক শিক্ষার্থী মাইসনাম উইনসন সিংয়ের (২৬) আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনার পেছনের কারণ ধোঁয়াশাপূর্ণ। 

দুজনের মধ্যে ঠিক কী হয়েছিল, কী কারণে রক্তারক্তির ঘটনা এবং উইনসন আত্মহত্যা করতে গেল এসব রহস্য জানা যায়নি। তবে পুলিশ আশা করছে, উইনসন সুস্থ হলে এসব প্রশ্নের জবাব মিলবে।
নগর পুলিশর উপকমিশনার (পশ্চিম) ফারুক উল হক বলেন, উইনসন ও আতিফের মধ্যে কোনো বিষয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে এই খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। পরে অনুতাপ থেকে উইনসন আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে বলে মনে হচ্ছে।
নগরের আকবরশাহ থানাধীন আবদুল হামিদ সড়কের একটি ফ্ল্যাটে গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে আতিফ শেখ খুন হন। একই ফ্ল্যাট থেকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় উইনসন সিংকে উদ্ধার করা হয়।
পরে উদ্ধার হওয়া উইনসন সিং এখন নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দুজনই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। আতিফকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। তাঁর শরীরে ১৫টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি থেকে এই খুন ও আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে মনে করছে।
আতিফ ভারতের আসামের গুয়াহাটি ও উইনসন মণিপুর রাজ্যের বাসিন্দা। নগরের আবদুল হামিদ সড়কের লেকভিউ সোসাইটির হাজী ইউসুফ ম্যানসনের পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে (ডি-২) তাঁরা ভাড়া থাকতেন। তিন কক্ষের ওই বাসায় আতিফদের অপর দুই সহপাঠী এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র গুরঙ্গ নিরাজ ও এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জোসনা তম্বুরামও থাকতেন। এ দুজনও ভারতের মণিপুরের।
পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) ফারুক উল হক বলেন, আতিফ ও জোসনা একসঙ্গে থাকতেন। তাঁরা দুজন এক কক্ষে, উইনসন এক কক্ষে এবং নিরাজ অপর কক্ষে থাকতেন। পুলিশ নিরাজ ও জোসনাকে রাত থেকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। একই সঙ্গে রাতে ওই ফ্ল্যাটে আসা তাঁদের আরও পাঁচ বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
পুলিশ জানায়, শুক্রবার রাতে ওই ফ্ল্যাটে তাঁরা বন্ধুরা মিলে মদ্যপান ও গল্প করছিলেন। একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাইরে থেকে আসা পাঁচ বন্ধু চলে যান। এরপর খুনের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানায়।
আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলমগীর জানান, আড্ডায় জোসনা অংশ নেননি। সামনে পরীক্ষা বিধায় তিনি তাঁর কক্ষে ছিলেন। বাইরের বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর নিরাজও নিজের কক্ষে চলে যান। তখনো আতিফ ও উইনসন মদ্যপান করছিলেন।
তিনি আরও জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে নিরাজ মূল দরজা বন্ধ করতে উঠে দেখতে পান উইনসনের কক্ষ বন্ধ। আলোও নেভানো। তখন তাঁর খটকা লাগে। তিনি বিকল্প চাবি দিয়ে কক্ষটি বাইরে থেকে খুলে ভেতরে ফ্যানের সঙ্গে উইনসনকে ঝুলতে দেখতে পান। পরে নিরাজ ও জোসনা মিলে উইনসনকে উদ্ধার করেন। এ সময় আতিফকে মেঝেতে রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে আলামতের কিছু মিল রয়েছে।
সহপাঠী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝুলতে দেখে উইনসনকে প্রথমেই পাসহ নিচ থেকে ধরে ফেলেন নিরাজ। এরপর জোসনাকে ডাকতে থাকেন। একপর্যায়ে একটি বঁটি দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে থাকা বেল্টটি কেটে ফেলেন। এরপর এই দুই মেডিকেল শিক্ষার্থী দুজনের নাড়ি দেখে উইনসনের প্রাণ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পরে ফোনে তাঁদের অন্য বন্ধুদের ডেকে আতিফকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসককে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। উইনসনকে প্রথমে নেওয়া হয় ইউএসটিসিতে। সেখান থেকে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে নগরের ম্যাক্স হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় তাঁকে।
আজ সরেজমিনে দেখা যায়, ম্যাক্স হাসপাতালের বাইরের আইসিইউর বাইরে উইনসনের কয়েকজন সহপাঠী অপেক্ষা করছেন। তাঁরা এ বিষয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
তবে উইনসন এখন আগের চেয়ে অনেকটা শঙ্কামুক্ত বলে জানা গেছে। তিনি হাত-পা নাড়ছেন। তাঁর জ্ঞান ফিরেছে। তবে কথা বলছেন না।
চমেক হাসপাতাল ও কলেজের নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আনিসুল ইসলাম খান বলেন, তাঁর সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করা হয়েছে। ব্রেইন কিংবা স্পাইনল কডে কোনো সমস্যা পাইনি। জ্ঞানও ফিরেছে। হয়তো ট্রমার কারণে কথা বলছেন না। আমরা ২৪ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রেখেছি।
এদিকে আজ সকালে আবদুল হামিদ সড়কের ওই ভবনে গিয়ে দেখা যায় ফ্ল্যাটটিতে তালা লাগিয়ে দিয়েছে পুলিশ। সিঁড়িতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে রয়েছে।
ভবনের তত্ত্বাবধায়ক বসির উদ্দিন বলেন, রাতে দেখি তাঁদের এক বন্ধু দৌড় দেন। তখন আমি ওপরে উঠে দেখি উইনসন খাটের ওপর পড়ে আছেন। আতিফ মেঝেতে রক্তাক্ত। নিচে নেমে আমি পুলিশকে ফোন করি।
থানায় চট্টগ্রামে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের সেকেন্ড সেক্রেটারি শুভাশীষ সিনহা এই খুনের বিষয়ে দুই শিক্ষার্থী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীর খোঁজও নেন।

পুলিশ জানায়, আড্ডা দেওয়ার জায়গায় ফল কাটার জন্য ছোরা ছিল। ওই ছোরা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। আতিফের শরীরে ১৫টি ক্ষত রয়েছে।
ওসি আলমগীর জানান, উইনসনকে আমরা নজরদারির মধ্যে রেখেছি। অন্যদিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নিরাজ ও জোসনাকে ইউএসটিসি কতৃর্পক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছি।