বিএনপির প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব, আলাদা কর্মসূচি পালন

>খুলনা আওয়ামী লীগে প্রকাশ্যে কোন্দল নেই। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি ও বিভক্তি আছে। চলছে নানা গুঞ্জনও। আর এখানকার বিএনপির নেতারা ব্যস্ত একে অপরকে দোষারোপ করতে। তাঁদের বিরোধ এতটাই প্রকাশ্য যে দলীয় কর্মসূচি আলাদাভাবে পালন করা হচ্ছে। এসব নিয়ে লিখেছেন রোজিনা ইসলাম, শেখ আল-এহসান ও উত্তম মণ্ডল

খুলনার মহানগর বিএনপির নেতারা ব্যস্ত একে অপরকে দোষারোপ করতে। আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ এনে একে অপরের দিকে তির ছুড়ছেন তাঁরা। বিরোধ এতটা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে যে কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্মসূচি দুটি পক্ষ আলাদাভাবে পালন করে। নেতাদের দ্বন্দ্বে হতাশ দলের সাধারণ কর্মীরা মনে করছেন, আগামী বছর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।

বিরোধের এক পক্ষে আছেন মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম ওরফে মঞ্জু এবং সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। অন্য পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহানগর বিএনপির কোষাধ্যক্ষ এস এম আরিফুর রহমান ওরফে মিঠু। নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী তিনি। তাঁর সঙ্গে যুক্ত আছেন খালিশপুর, দৌলতপুর, আড়ংঘাটা ও সোনাডাঙ্গা থানার কিছু নেতা-কর্মী।

 নগরের ছয়টি থানার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা প্রথম আলোকে জানান, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিএনপির কমিটি গঠন নিয়েই মূলত বিরোধ শুরু হয়। দলটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সাহরুজ্জামান মোর্তুজা প্রথম দিকে আরিফুর রহমানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে তিনি রয়েছেন সভাপতি নজরুল ইসলামের পক্ষে।

জানতে চাইলে মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা বিএনপির রাজনীতিতে আরিফুর রহমানের কোনো অবদান নেই। তিনি ডাকাত ও মাদকসেবীদের নিয়ে দল করেন। তাঁর সঙ্গে দলের কোনো লোক নেই।

পাল্টা অভিযোগ করে মহানগরের কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান জানান, নগর সভাপতি দলের মধ্যে একক আধিপত্য বিস্তার করছেন। তিনি দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের গুরুত্ব দেন না।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান মেয়র মনিরুজ্জামান প্রার্থী হলে সহযোগিতা করবেন কি না—জানতে চাইলে আরিফুর রহমান বলেন, মেয়র দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।

গত ৫ নভেম্বর থানা বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতিসহ পাঁচজন আহত হন। এরপর থেকেই নজরুল ইসলাম ও আরিফুর রহমানের অনুসারীরা মুখোমুখি অবস্থান নেন।

এরই সূত্র ধরে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আরিফুর রহমানসহ ছয়জনকে অব্যাহতি দেয় মহানগর কমিটি। আর বিলুপ্ত করা হয় খালিশপুর থানা কমিটি। এ ঘটনায় খালিশপুর থানার নেতারা ওই এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন মহানগর সভাপতিকে। তাঁরা খালিশপুর ও দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে ও কয়েক দফা নজরুল ইসলামের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। এরপর নানা ঘটনায় দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে কেন্দ্র থেকে সম্মেলন স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

এরপর থেকেই দুটি পক্ষ আলাদা আলাদাভাবে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করে আসছে। সভা, সমাবেশ, মিছিল, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালন, ইফতার পার্টিসহ সবকিছুই আলাদাভাবে করছে দুটি পক্ষ। সম্প্রতি নতুন ৫০ হাজার সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রমও আলাদাভাবে চালাচ্ছে তারা।

মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে চলছেন বলে অভিযোগ করে মহানগর ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি নুরুজ্জামান বলেন, তাঁরা যোগ্য কাউকে দলে ভেড়াতে চান না। কারণ, তাঁরা নতুন নেতৃত্বকে ভয় পান।

নগর বিএনপির প্রচার সম্পাদক আসাদুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী কে হবেন, তা নিয়ে মূলত এ দ্বন্দ্ব। প্রার্থী চূড়ান্ত হলে বিরোধ মিটে যাবে। তিনি আরও বলেন, আরিফুর রহমান নোয়াখালীর লোক বলে দলের মধ্যে একটু বেশি প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন।

জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের করা কমিটিতে নগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন এম নূরুল ইসলাম ওরফে দাদু ভাই, সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম ওরফে মঞ্জু ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন বর্তমান মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এমন পরিস্থিতিতে ২০০৫ সালে হঠাৎ করেই কেন্দ্র থেকে আলী আজগর লবীকে আহ্বায়ক ও সাহরুজ্জামান মোর্তুজাকে সদস্যসচিব করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। তবে ওই কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে নজরুল ইসলামসহ অন্যরা দলের আগের পদবি ব্যবহার করে সভা-সমাবেশসহ কেন্দ্রীয় কার্যক্রম চালিয়ে যান। এ সময় আলী আজগর ও মোর্তুজাও দলীয় পরিচয় নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

সর্বশেষ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান আলী আজগর। তাঁর অনুসারীরাও আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে সরে যান। ২০০৯ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে করা মহানগর কমিটিতে সভাপতি হন নজরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান। আর নজরুল ইসলামের একান্ত বিশ্বস্ত হিসেবে কোষাধ্যক্ষ করা হয় আরিফুর রহমানকে। তাঁকে খালিশপুর থানা কমিটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে নজরুল ইসলাম ও আরিফুর রহমানের মধ্যেই বিরোধ চলছে।