ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ৮২% তরুণ

দেশের তরুণদের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চে সারা দেশে জরিপ করেছে। এতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, পারিবারিক মূল্যবোধের মতো বিষয় নিয়ে তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। তরুণেরা কী ভাবে, অবসরে কী করে, বিনোদনের জন্য কোন মাধ্যম পছন্দ করে—এসবও ছিল জরিপের বিষয়বস্তু

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ-অসন্তোষের মাত্রা প্রায় কাছাকাছি। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট বেশির ভাগ তরুণ। তাতে অবশ্য ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনাহীন নয় তারা। দেশের বড় ধরনের অর্থনৈতিক উন্নতিতেও চাকরির বাজারে ঢুকলে কাজ পাওয়ার বিষয়ে খুব একটা আশাবাদী নয় তরুণেরা।

প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৭৪ শতাংশ তরুণ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু তারপরেও ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র নিয়ে ভরসা করতে পারছে না ৮২ শতাংশের বেশি তরুণ। প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ তৈরি না হওয়ায় এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির যে মন্দা, তাতে তারা নিজেদের নিয়ে খুব আশাবাদী হতে পারছে না।

আবার জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৬৩ শতাংশই বলছে, তারা জানে না তাদের জীবনের লক্ষ্য কী। দেশের দুর্নীতি নিয়ে তারা চিন্তিত, দেশের আইনকানুন নিয়ে আছে তাদের উদ্বেগ, এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও তরুণেরা চিন্তিত। ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ উদ্বিগ্ন তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই। সব মিলিয়ে উজ্জ্বল কোনো ভবিষ্যতের ছবি নিজেরাই আঁকতে পারেনি তরুণেরা।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয় হলেও সেই প্রবৃদ্ধি কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে, সেটা নিয়েও এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যও বলছে, গত চার-পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সেভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি। তাই বড় প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সুফল জনগণ কতটা পাচ্ছে। তরুণ অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান এ পরিস্থিতিতে মনে করেন, কর্মসংস্থান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে তরুণদের এই যে উদ্বেগ, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তাদের একটি বড় অংশ কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তরুণ জনগোষ্ঠীর ওই অংশটি কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সেটি তাদের প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে বড় ধরনের একটি সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না ভালোভাবে। এতে তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।

প্রথম আলোর এই জরিপ দেশের তরুণদের নিয়ে। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণেরা জানিয়েছে তাদের এই আশা-আকাঙ্ক্ষা আর উদ্বেগের কথা। বিশ্বব্যাপীই এই মোট জনসংখ্যায় তরুণদের সংখ্যা বেশি। জাতিসংঘের সংজ্ঞায় ‍যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে, তাদেরই তরুণ বলা হয়। এখন অবশ্য আরও কিছু নাম দেওয়া হয়েছে তরুণদের। যেমন ১৯৮০ সালের পরে যারা জন্ম নিয়েছে, তাদের এখন বলা হচ্ছে মিলেনিয়াল প্রজন্ম।

বিশ্বের দেশে দেশে তরুণ ও মিলেনিয়াল প্রজন্ম নিয়ে হচ্ছে নানা ধরনের সমীক্ষা ও জরিপ। অস্ট্রেলিয়ায় গত ফেব্রুয়ারিতে এ ধরনের যে জরিপটি করা হয়েছে, সেখানেও তরুণদের নানা ধরনের আশা-হতাশার কথা আছে। ‘দ্য নিউ ডেলয়েট ২০১৭ মিলেনিয়াল সার্ভে’তেও দেখা যাচ্ছে, সেখানে তরুণেরা অর্থনীতিতে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। চাকরির বাজার সংকুচিত হওয়া নিয়ে শঙ্কিত।

আবার জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে কাজ করা বিভাগ ইউএন ডেসা (ইউনাইটেড ন্যাশনস ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স) প্রতি দুই বছর পরপর বিশ্বের তরুণদের নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে।

চলতি বছর এবারের রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা আছে, ‘যে ধরনের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে তরুণেরা বসবাস করে, সেটার ওপর নির্ভর করে ওই পরিবেশে তারা কতটুকু যুক্ত হচ্ছে বা মানিয়ে নিচ্ছে। অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহার, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পারার মতো বিষয়গুলো দীর্ঘ মেয়াদে একজন তরুণকে ব্যক্তিগতভাবে ও সমাজকে লাভবান করতে পারে। অন্যদিকে ভালো কাজের অভাব, শ্রম অধিকার চর্চার সীমিত সুযোগ এবং সামাজিক সেবা নিতে বাড়তি ব্যয় একজন তরুণের সমাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সামর্থ্যকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ধরনের পরিস্থিতি বৃহৎ পরিসরে উন্নয়ন ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’

ঠিক এই কথাগুলোরই প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে তারুণ্য জরিপ-২০১৭-এ। যেমন বাংলাদেশেও তরুণেরা রাজনীতিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে, দ্রুত প্রসার ঘটছে অবাধ ইন্টারনেটের ব্যবহার, ভালো কাজের অভাব নিয়ে চিন্তিত তরুণেরাই। অস্বস্তি আছে দেশের সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েও। এসবই সমাজের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধাগ্রস্ত করছে এসব তরুণকে। অথচ দেশকে আরও এগিয়ে নিতে তরুণদের সামর্থ্যের দিকেই ভরসা করে আছে পুরো দেশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিকভাবে দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের সার্বিক যে অবস্থা, তাতে নিরাপত্তা ও সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে স্বস্তিবোধ করার বাস্তব অবস্থা নেই। শুধু তরুণ নয়, সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে এখন নিরাপত্তা ও সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে।

এই তরুণেরা কি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট? জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের কাছে। দেখা যাচ্ছে তরুণদের বড় অংশই দেশের রাজনীতি নিয়ে তাদের সন্তুষ্টির কথা বলেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮ শতাংশই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট। আবার অসন্তুষ্টের সংখ্যাও কম নয়। ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ বলেছে তাদের অসন্তোষের কথা।

সন্তোষ-অসন্তোষের মধ্যে অবশ্য মাত্রাগত কিছু পার্থক্য আছে। যেমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট ৮ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ। বাকি ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ মোটামুটি সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নেই এমন তরুণ হচ্ছে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। আর কিছুটা অসন্তোষ আছে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণের। তা ছাড়া এ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারেনি ৯ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অবশ্য একটা বড় ধরনের পার্থক্য দেখা গেল। যেমন ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ ছেলে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানালেও মেয়েদের মধ্যে এই হার অনেক কম, ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে ৪০ শতাংশ ছেলে বলেছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে, মেয়েদের মধ্যে এই হার বেশি, ৪৫ শতাংশ।

আবার জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৫১ দশমিক ২ শতাংশ রাজনীতি নিয়ে তাদের অনাগ্রহের কথা সরাসরি জানিয়েছে। রাজনীতি নিয়ে তরুণদের অনীহাকে রাষ্ট্রের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় বলেই মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শান্তনু মজুমদার। তিনি বলেন, ‘তরুণদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে অনীহা শুধু নয়, একধরনের রাজনীতি-বিরোধিতা রয়েছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা—সবটা মিলিয়ে যে পরিবেশ, তা মোটেই তরুণদের রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে না।’

রাজনীতিতে আকৃষ্ট হওয়ার মতো কোনো রোলমডেলও তরুণদের সামনে এখন নেই। এখনকার পরিবারগুলোও সন্তানের রাজনীতি-সম্পৃক্ততাকে ভালো চোখে দেখে না। এমনকি পরিবারের পক্ষ থেকেও রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা তৈরি না করতে সন্তানদের প্রতি নির্দেশ বা চাপ তৈরি করা হয়। ফলে রাজনীতি নিয়ে একধরনের অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছে তরুণদের মধ্যে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতি নিয়ে তরুণদের এই অনাগ্রহ বা হতাশার সঙ্গে অর্থনীতির যোগসূত্র কতটা? বিশেষজ্ঞরা কিন্তু মনে করেন, সম্পর্ক একটা আছে এবং তা যথেষ্ট গভীর।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান যেমনটি বললেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত হতে না পেরে তরুণদের একটি বড় অংশ রাজনীতির প্রতিও অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। কারণ তারা মনে করছে, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন কোনো কিছু নয়। ফলে তরুণদের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হচ্ছে। সেখান থেকে তারা নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ প্রক্রিয়াটি দেশের জন্য কোনোভাবে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর নয়।

দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ তরুণই নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ এসব তরুণ শিক্ষায় নেই, চাকরি করছে না, আবার চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না। আবার বিবিএসের হিসাবে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে। এই অবস্থায় অর্থনীতি নিয়ে সন্তুষ্টের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের কথাই জরিপে বলেছে তরুণেরা।