বছরে ২৫ লাখ টন এলএনজি দেবে কাতার

কাতার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য একটি চুক্তি অনুস্বাক্ষর করেছে পেট্রোবাংলা। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় কাতারের রাসগ্যাসের সঙ্গে পেট্রোবাংলা এই চুক্তি সই করে। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের পর চূড়ান্ত চুক্তি আগামী আগস্টে সই হবে। এটিই দেশে এলএনজি আমদানির প্রথম চুক্তি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার সূত্রগুলো জানায়, চুক্তি অনুযায়ী রাসগ্যাস ১৫ বছর ধরে, প্রতিবছর ২৫ লাখ মেট্রিক টন করে এলএনজি বাংলাদেশে সরবরাহ করবে। এর দাম নির্ধারিত হবে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম অনুযায়ী। এভাবে দাম নির্ধারণের একটি ফর্মুলায় দুই পক্ষই একমত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০১১ সালে এলএনজি আমদানির ব্যাপারে কাতারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছিল।
প্রতিবছর ২৫ লাখ মেট্রিক টন এলএনজি আমদানিতে বাংলাদেশের কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হতে পারে, জানতে চাইলে সূত্রগুলো বলে, এর একটি সম্ভাব্য প্রক্ষেপণ তৈরি করা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত চুক্তি সইয়ের আগে এ ব্যাপারে কোনো তথ্যই প্রকাশ করা হবে না। সে জন্যই চুক্তি সইয়ের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। সূত্রগুলোও নাম প্রকাশে রাজি হয়নি। তবে এলএনজি আমদানির বিল পরিশোধের জন্য পেট্রোবাংলা সরকারের কাছে ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।
অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান গ্যাস-সংকটের কারণে সরকার ২০১০ সালেই এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা নেয়। অনভিজ্ঞতা, জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরকারের মধ্যে নানা রকম টানাপোড়েনের কারণে দীর্ঘ সাত বছরের মাথায় পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজি মহেশখালীতে নির্মাণাধীন একটি এফএসআরইউর (ভাসমান টার্মিনাল ও পুনঃ গ্যাসে রূপান্তর করার ইউনিট) মাধ্যমে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ করা হবে।
মহেশখালীতে ওই এফএসআরইউটি স্থাপন করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। আগামী বছরের মধ্যভাগে এটি স্থাপনের কাজ শেষ হতে পারে। এরপর এলএনজি আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হবে। এই এফএসআরইউর মাধ্যমে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই গ্যাস সরবরাহ আগামী বছরের শেষ নাগাদ শুরু হতে পারে।
সরকার এটি ছাড়া এলএনজি আমদানির আরও কয়েকটি স্থাপনা তৈরি করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের শীর্ষ স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ মহেশখালীতে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি এফএসআরইউ স্থাপন করছে। সেটি থেকেও আগামী বছরের শেষ নাগাদ গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে।
এ ছাড়া সরকারি খাতের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় একটি এফএসআরইউ স্থাপনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স একটি এফএসআরইউ স্থাপন করে এলএনজি আমদানি করবে। এর একাংশ তাঁরা মেঘনাঘাটে স্থাপনের প্রক্রিয়াধীন ৭৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করবে। অবশিষ্টাংশ সরকারের কাছে বিক্রির চেষ্টা করছে।
শুধু ভাসমান টার্মিনাল নয়, সরকার স্থলভাগেও এলএনজি আমদানির দুটি স্থাপনা নির্মাণের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। সরকারি খাতের রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) বিষয়টি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পেয়েছে। তাঁরা ইতিমধ্যে এ দুটি স্থাপনা তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য জাপানের টোকিও গ্যাসকে নিয়োগ দিয়েছে।
পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, এলএনজি আমদানির জন্য তারা সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক কোম্পানি ‘এওটি’-এর সঙ্গে একটি এমওইউ সই করেছে। এই বছরে শেষ দিকে তাদের সঙ্গেও পেট্রোবাংলার চুক্তি হতে পারে। এ ছাড়া খোলা বাজার (স্পট মার্কেট) থেকেও এলএনজি আমদানির জন্য সরকার আগ্রহী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আগ্রহপত্র চেয়েছে।
সরকারের এসব উদ্যোগই গ্যাস আমদানি করে দেশের চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে পরিচালিত। এতে গ্যাসের দাম বাড়বে। কারণ, জ্বালানির দাম কমলেও দেশের তুলনায় আমদানি করা গ্যাসের দাম বেশি পড়বে। তা ছাড়া সরকার গ্যাস আমদানি করে চাহিদা পূরণ করার ব্যাপারে যতটা উদ্যোগী, দেশের মধ্যে (স্থলভাগ ও সমুদ্রসীমায়) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ততটা নয় বলে সমালোচনা রয়েছে।
পেট্রোবাংলা হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৮০ কোটি (৩৮০০ মিলিয়ন) ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে দৈনিক ২৭০ কোটি ঘনফুটের মতো। ফলে সব খাতেই গ্যাসের সংকট চলছে। প্রায় সব খাতেই নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতে গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে ২০১০ নাল থেকে। সরকার এলএনজি আমদানি করে এ সংকট মোকাবিলা করার নীতি নিয়েছে।