গাইবান্ধার পাঁচ আসনই হাতছাড়া হলো জাপার

জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত গাইবান্ধার পাঁচটি আসনই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির হাতছাড়া হয়েছে। আসনগুলোর চারটিতে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এবং বাকি আসনের বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীও আওয়ামী লীগের। তিনি হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে।
আসনগুলো হাতছাড়া হওয়ায় জেলার জাপা নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এদিকে নির্বাচনের পর বিজয়ী-বিজিত প্রার্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনেছেন।
জেলায় পাঁচটি আসন থাকলেও ভোট গ্রহণ হয় চারটি আসনে। অপরটি গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনর্নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ফজলে রাব্বী। ৫ জানুয়ারি গাইবান্ধা-২ আসনের ফলাফল নির্ধারিত হয়। সহিংসতার কারণে বাকি তিনটি আসনের ২০৬টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সেদিন স্থগিত করায় এসব আসনের ফলাফল নির্ধারিত হয় গত বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণের পর।
গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মাহবুব আরা বেগম। গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্যাপুর-পলাশবাড়ী) আসনটি ২৭ বছর পর জাপার হাতছাড়া হলো। এ আসনের গত ছয়বারের সাংসদ জাপার টি আই এম ফজলে রাব্বী চৌধুরী এবার প্রার্থী হননি। ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম এ আসনে বিজয়ী হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইউনুস আলী সরকার (নৌকা প্রতীক)। তিনি সাদুল্যাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে পরাজিত করেছেন একই দলের নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ (আনারস)। তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে সাবেক সাংসদ জাপার প্রার্থী আবদুল কাদের খানকে (লাঙ্গল) এক লাখ পাঁচ হাজার ১০৮ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের মনজুরুল ইসলাম (নৌকা)।
অবশ্য বেশি আলোচনা হয় গাইবান্ধা-৪ আসন নিয়ে। দলীয় সূত্র জানায়, এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। তবে গত পাঁচ বছরে তিনি ক্রমে দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অন্যদিকে ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া আওয়ামী লীগের নেতা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগ দেন দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী। এবারও মনোয়ার হোসেনকে দল মনোনয়ন দিলে আবুল কালাম স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেন এবং ৩৩ হাজার ৯৩২ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন।
মনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, ‘আবুল কালাম আজাদ নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ৫ জানুয়ারি ভোট হওয়া ৫৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭ কেন্দ্র দখল করে একচেটিয়া আনারসের পক্ষে সিল মারেন। বিষয়টি সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনে লিখিতভাবে জানানো হলেও প্রতিকার পাইনি।’ তিনি বলেন, ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়নি, তার প্রমাণ সেদিন ৫৮ কেন্দ্রে আমি ১৮ হাজার ৮০৬ ভোট পাই। আবুল কালাম আজাদ পান ৫৯ হাজার ৮৬২। অথচ বৃহস্পতিবার সুষ্ঠুভাবে ভোট হওয়ায় আমি ৭২টি কেন্দ্রে ৪৫ হাজার ৮০৮ ভোট পাই আর আবুল কালাম পান ৩৮ হাজার ৬৮৪ ভোট। কিন্তু আগের কারচুপির কারণে শেষ পর্যন্ত আমি নির্বাচিত হতে পারলাম না।’
এই অভিযোগ অস্বীকার করে আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর ফেব্রুয়ারির পর থেকে গাইবান্ধার সব উপজেলায় জামায়াত-শিবির সহিংসতা চালালেও গোবিন্দগঞ্জে আমি কোনো সহিংসতা চালাতে দিইনি। ফলে নেতা-কর্মীরা সবাই আমার সঙ্গে ছিলেন। জনগণই আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছেন।’
গাইবান্ধা-১ আসনে বরাবর জাপা জয়ী হলেও ২০০১ সালে জয়ী হয় জামায়াত। ২০০৮ সালে জয়ী হন জাপার প্রার্থী আবদুল কাদের খান। এবার তাঁকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনজুরুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, ২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে কাদের খান নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিপদে-আপদে পাশে থাকেননি। এতে তাঁরা ক্ষুব্ধ ছিলেন।
অবশ্য আবদুল কাদের খান বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ায় ১৬ জানুয়ারির নির্বাচন তিনি বর্জন করেছেন। আর মনজুরুল ইসলাম বলেন, এখানে লাঙ্গলের ভরাডুবি হয়েছে। মানুষ আবার নৌকায় আস্থা খুঁজে পেয়েছে।
গাইবান্ধা-২ আসনে জেলা জাপার সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ দলের চেয়ারম্যানের নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করায় মাহবুব আরাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মকদুবুর রহমানের তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়নি।
গাইবান্ধা-৩ আসনে ইউনুস আলীর কাছে হেরেছেন জাসদ নেতা ও সাদুল্যাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম। দুজনের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান এক লাখ নয় হাজার ৩৫৯। খাদেমুল বলেন, ৫ জানুয়ারি এখানে ভোট ডাকাতি হয়েছে। তাই তিনি ১৬ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেন। অভিযোগ অস্বীকার করে ইউনুস বলেন, শেখ হাসিনার উন্নয়নকাজ দেখে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নৌকায় ভোট দিয়েছে।
সব আসনে জয়ের পরিপ্রেক্ষিতে গাইবান্ধার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামস-উল-আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানকার চারটি আসনে সরাসরি আওয়ামী লীগ এবং আরেকটিতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এর মাধ্যমে গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগের ভিত্তি আরও মজবুত হলো। আমরা মনে করছি, এতে গাইবান্ধার উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।’
গাইবান্ধায় সব আসন হারানোর প্রভাব কী হবে, জানতে চাইলে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, ‘পাঁচটি আসনের সব হাতছাড়া হওয়ায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। তবে আমরা যেহেতু দল করি, কাজেই দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে কাজ চালিয়ে যাব।’