জঙ্গিবাদ বাড়ছে দারিদ্র্যে ও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায়

দেশের তরুণদের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চে সারা দেশে জরিপ করেছে। এতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, পারিবারিক মূল্যবোধ, অবসরে কী করে, সে বিষয়েও তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়

দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানকে আর্থসামাজিক বিভিন্ন সমস্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছে দেশের তরুণ প্রজন্ম। জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ শতাংশের মতে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা এবং অপব্যবহার করেও তরুণদের একটি অংশকে জঙ্গিবাদে আনা হচ্ছে। আবার বেকারত্ব ও দারিদ্র্য তরুণদের জঙ্গিবাদের পথে টেনে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করে ৭২ শতাংশ তরুণ।

এ ছাড়া ৪৯ শতাংশ তরুণের ধারণা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ও অশিক্ষার মতো বিষয়গুলো জঙ্গিবাদ উসকে দিতে প্রভাবকের ভূমিকা রাখছে।

জরিপে তরুণদের কাছে জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। মোটা দাগে তরুণদের জবাবকে তিনটি বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যকে তরুণেরা জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ধর্মের অপব্যবহার ও ভুল ব্যাখ্যা, ইসলাম ধর্মের সমালোচনা, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে দেখা হয়েছে জঙ্গিবাদের ধর্মীয় দিক হিসেবে। আর মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ও অশিক্ষাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সামাজিক দিক থেকে।

গত নব্বইয়ের দশক থেকেই দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার দেখা যাচ্ছিল। তবে গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকে তা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এর আগে দরিদ্র ও কম শিক্ষিতদের মধ্যে জঙ্গিবাদের প্রসার দেো গেলেও এখন শিক্ষিত এবং অবস্থাপন্ন ঘরের তরুণেরা এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ধর্মকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে তরুণদের একটি অংশকে বিভ্রান্ত করে উগ্রপন্থায় আনা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জরিপে তরুণদের কাছেই জানতে চাওয়া হয়েছিল জঙ্গিবাদের প্রসার নিয়ে তাদের ভাবনা।

বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বড় কারণ

এক-তৃতীয়াংশ তরুণ জানিয়েছে, কাজ করার সামর্থ্য থাকার পরও বেকার জীবনযাপনের হতাশা থেকে অনেকে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। বেকারত্বের কারণে যে জঙ্গিবাদ সবচেয়ে বেশি বাড়ছে, এ বিষয়ে শহর, গ্রাম, ছেলেমেয়ে—সব শ্রেণির তরুণ একমত।

জরিপের তথ্য বলছে, রংপুর ও সিলেট বিভাগের তরুণেরা বেকারত্বকে জঙ্গিবাদের সবচেয়ে বড় কারণ মনে করে। রংপুর বিভাগের ৫৬ শতাংশ ও সিলেট বিভাগের ৪৮ শতাংশ তরুণ বিষয়টিকে জঙ্গিবাদ প্রসারের মূল কারণ মনে করে। এমনটি ভাবার প্রবণতা খুলনা ও বরিশাল বিভাগের তরুণদের মধ্যে বেশ কম, যথাক্রমে ১৩ ও ৭ শতাংশ।

নানা দিক থেকে বেকারত্বকে তরুণেরা দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে করলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা এখন প্রায় ২৬ লাখ। তবে যাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ পান না, তাঁদের বেকার হিসেবে ধরা হয়। এর বাইরে দেশে আরও ৮৬ লাখ মানুষ আছেন, যারা পরিবারে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না। বিবিএসের জরিপই এখন বলছে, দেশে কাজের সুযোগ কম তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে বেকারত্বের বিষয়টি জরিপে বারবার উঠে এসেছে।

বেকারত্বের পর জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির বড় কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে উল্লেখ করেছে তরুণেরা। ২৮ শতাংশ তরুণের মতে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য পরস্পর সম্পর্কিত। বেকার থাকার কারণে অনেক তরুণ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, এর ফলে তাদের একটি অংশ জঙ্গিবাদের মতো ভুল পথে চলে যাচ্ছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কারণে তৈরি হওয়া হতাশা থেকেও অনেকে জঙ্গিবাদে চলে যাচ্ছে বলে মনে করে ৬ শতাংশ তরুণ।

দারিদ্র্যকে জঙ্গিবাদ প্রসারের সবচেয়ে বড় কারণ মনে করে চট্টগ্রাম বিভাগের তরুণেরা (৩৯ শতাংশ)। খুলনা, রংপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে এমন মতামত দিয়েছে ২০ থেকে ২৪ শতাংশ তরুণ। আবার শহরের চেয়ে গ্রামের তরুণেরা জঙ্গিবাদ বিস্তারে দারিদ্র্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। শহরের ২৩ শতাংশ তরুণ দারিদ্র্যকে জঙ্গিবাদ প্রসারের মূল কারণ মনে করে, গ্রামে এমনটি মনে করে ৩০ শতাংশ। লিঙ্গভেদে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা দারিদ্র্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য যখন সমাজে বাড়তে থাকে, তখন এটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে তরুণদের। বেকার তরুণ তো বটেই, যিনি এখন একটি চাকরি করেন তিনিও এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য হতাশ তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি করছে।

ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহার

জরিপে ৫৮ শতাংশ তরুণ বলেছে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ ধর্মের অপব্যবহারের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে আর ২৫ শতাংশ জোর দিয়েছে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার বিষয়টিকে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারকেও তরুণদের একটি অংশ জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির কারণ মনে করে। তাদের মতে, ইসলাম ধর্ম নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে অনেক সমালোচনা আছে, যেগুলো সঠিক নয়। এসব নেতিবাচক প্রচারণার জবাব দিতে গিয়ে অনেক তরুণ জঙ্গিবাদের মতো চরমপন্থায় আকৃষ্ট হয়। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার কারণেও একটি অংশ জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে বলে কিছু তরুণ (৪ দশিমক ৬ শতাংশ) মতামত দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগের তরুণেরা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারকে জঙ্গিবাদ প্রসারের প্রধান কারণ মনে করে। চট্টগ্রামে ৩৯ থেকে ৪৮ শতাংশ তরুণ বিষয়টিকে বড় সমস্যা মনে করে। তবে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহের তরুণেরা ধর্মের ভুল ব্যবহারকে তত বড় সমস্যা মনে করে না। এই তিন বিভাগের ২৩ থেকে ১৯ শতাংশ তরুণ ধর্মকে জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির কারণ মনে করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে তরুণদের অংশগ্রহণের সুযোগ ও সম্ভাবনা সীমিত হয়ে আসছে। এতে করে তরুণদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব অনুভূত হচ্ছে। বর্তমান রাজনীতি ও অর্থনীতি তরুণদের সামনে কোনো আদর্শ তৈরি করছে না। এসব সমস্যা যতই অস্বীকার করা হবে, ততই এগুলো বাড়তে থাকবে। কারণ বিচ্ছিন্ন মানুষই উগ্রপন্থা গ্রহণ করে।

সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অশিক্ষা

অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে কি না। উত্তরে ১৮ শতাংশ তরুণ বলেছে, সামাজিক মূল্যবোধের ধারাবাহিক অবক্ষয় ও অশিক্ষা বা ভুল শিক্ষার কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের তরুণদের মত একই রকম। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবের কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে এমনটি মনে করে ১২ শতাংশ তরুণ।

সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অশিক্ষাকে জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রধান কারণ মনে করে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ তরুণ। এ ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের তরুণদের মতামত একই রকম। সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবের কারণে জঙ্গিবাদ বাড়ছে এমনটি মনে করে ১২ শতাংশ তরুণ। মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা শিক্ষার অভাবকে জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মনে করে।

বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের ‘জার্নাল ফর ডির‍্যাডিক্যালাইজেশন’ নামে একটি অনলাইন প্রকাশনা রয়েছে। তাতে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার পিএইচডি গবেষক আজিজুর রহমানের ‘বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের ধরন এবং কার্যক্রম’ শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী লেখা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক দোষারোপের সংস্কৃতি, অস্ত্রের সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বাড়ছে। গবেষণাধর্মী এই লেখায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গবেষণায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, এনজিও, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি সমন্বিত কর্মকৌশল বাস্তবায়নের পরামর্শ এবং তরুণদের আকর্ষণে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যে মতবাদ ও কর্মকৌশল ব্যবহার করে, সেগুলো চ্যালেঞ্জ করে বিপরীত মতবাদ প্রকাশে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।

অর্থনৈতিক কারণ

বেকারত্ব ৩৭.৩%

দারিদ্র্য ২৭.৮

হতাশা ৬.৪

ধর্মীয় কারণ

ভুল ব্যবহার ৩২.৮%

অপব্যাখ্যা ২৫

সমালোচনা ৮.৭

সামাজিক কারণ

মূল্যবোধের অবক্ষয় ১৭.৬%

ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ১২.৪

অশিক্ষা ১৯.২