আউশ নষ্ট, শঙ্কা আমন নিয়েও

মৌলভীবাজারে এ বছরের চলতি বন্যায় পানিতে তলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমির আউশ। এদিকে হাওরসংলগ্ন এলাকায় রোপা আমনের খেতেও এখন থইথই পানি। এতে আমন নিয়েও শঙ্কিত কৃষকেরা।

গতকাল সোমবার সকালে রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাঁচগাঁও, শ্রীভূমি, কানিকুল, উতাইসার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকেরা যে জমিতে আউশ ও আমন (স্থানীয় নাম কাতারি) চাষ করেছিলেন, সেসব জমি কোমর ও বুকপানিতে তলিয়ে আছে। এলাকাগুলো কাউয়াদীঘি হাওরসংলগ্ন। মাঠের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে আমনের কয়েক ইঞ্চি ডগা পানির ওপর ভাসছে। তা থেকে ধান পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আউশ ধানের অধিকাংশ জমি পুরোপুরি পানির নিচে। জমিতে আগাছা আর শাপলা-শালুক ভেসে আছে। কিছুটা ওপরের জমিতে যে আউশ লাগানো হয়েছিল পানি কিছুটা কমায় ছড়ার অর্ধেক বা আরেকটু বেশি ভেসে উঠেছে। থোড় বের হওয়ার সময় পানিতে তলিয়ে যাওয়া এসব জমি থেকেও খুব একটা ফলন পাওয়া যাবে না। এতে চিটার পরিমাণ বেশি হবে বলে জানান কৃষকেরা।

এদিকে কিছু এলাকায় রোপা আমনের হালি চারা তলিয়ে গেছে। তুলনামূলক উঁচু জমিতে যাঁরা হালি চারা তৈরি করেছেন, সেই চারাও এখন রোপণের সময় এসেছে। কিন্তু লাগানোর খেতে এখন পানি। জমি থেকে এই পানি না কমা পর্যন্ত আমনের চারা রোপণের সুযোগ নেই। এ নিয়ে কৃষকেরা উদ্বিগ্ন।

উতাইসার গ্রামের আকবর মিয়া বলেন, সারা এলাকা ডুবে গেছে। ছয় বিঘায় আমন চাষ করেছিলেন। বীজ তোলার সুযোগ নেই। পাঁচ বিঘায় করেছিলেন আউশ। তিন বিঘাই পানির নিচে। তাঁর কথায়, ‘আউশ তো খাইছে খাইছে। অখন হাইল খেতর (রোপা আমনের) ভরসা নাই। হাইল খেতর জাগাত আটু (হাঁটু) পানি, কোনো জাগাত কমর (কোমর) পানি।’ তিনি জানান, ২৫ বিঘার মতো জমি তৈরি করেছিলেন। চারা রোপণের সময় আসছে। সবটাই পানির নিচে। শ্রাবণ মাসেও না রোপণ করতে পারলে জমি পতিত থাকবে। একই গ্রামের জয়নাল মিয়া বলেন, আমনের জন্য ৩০ বিঘা জমি হাল চাষ দিয়ে রেখেছিলেন। জমি এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে। কোন দিন পানি নামবে বুঝতে পারছেন না।

গ্রামের আনু মিয়ার প্রায় দেড় বিঘা জমির হালি চারা পানিতে তলিয়ে। কিছু চারার অর্ধেক ভেসে আছে। রোপণের জমি তলিয়ে থাকায় সেই চারাও কাজে লাগাতে পারছেন না। তাঁর ভাতিজা মখলিছ মিয়া একটি চারা জমিতে নেমে দেখালেন, সেখানে হাঁটুপানি। চারার বেশির ভাগ পানির নিচে। এ চারা আর কাজে লাগবে না। তিনি বলেন, ‘চাইরের (২০০৪ সাল) পর আর এত পানি অইছে না।’

এ অবস্থা রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরসংলগ্ন ফতেহপুর ও উত্তরভাগ ইউনিয়নেও। স্থানীয় কৃষকদের অনেকে জানালেন, এখানকার মানুষের প্রধান ফসল বোরো। অনেকে আউশ চাষ করেন না। কিন্তু এ বছর পানিতে ও শিলাবৃষ্টিতে বোরো নষ্ট হওয়ায় তাঁরা আউশ চাষ করেছিলেন। সেই ধানও তাঁরা ঘরে তুলতে পারলেন না।

হাকালুকি হাওরসংলগ্ন কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলাতেও বন্যায় আউশ নষ্ট হয়েছে। হাইল হাওরসংলগ্ন সদর উপজেলার নাজিরাবাদ ও পাশের শ্রীমঙ্গল উপজেলার যতরপুর এলাকাতেও নষ্ট হয়েছে আউশ। নাজিরাবাদ ইউনিয়নের আটঘরের হাসন খাঁ বলেন, ‘আউশও নাই। আমনের আলি চারাও (হালি চারাও) নষ্ট অইছে।’ যতরপুর গ্রামের আনকার মিয়া বলেন, ‘তিন কিয়ার আউশ করছিলাম। সব পানির তলে।’

রাজনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমন লাগানোর সময় এখনো যায়নি। তবে আমরা দেরিতে লাগানো যায় বিআর-২২ ও বিআর-২৩ জাতের ধান রোপণে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। এর বীজ সরাসরি সরকারি বীজ বিপণন কেন্দ্র থেকে কৃষকেরা কিনতে পারবেন। এখনই চারা করার সময়। এ জাতের চারা ২০ আগস্ট পর্যন্ত লাগানো যাবে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় বন্যায় ৪ হাজার ২২৫ হেক্টর জমির আউশ পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭০৭ হেক্টর সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত দুদিন বৃষ্টি নাই। এটা একটা ভালো খবর। যদিও পানি এখনো তেমন কমেনি। পানি নামার পর যে জাতটা দেরিতে লাগালে ফলন ভালো হয় সে জাতটাকেই বেছে নিতে হবে। পুরোনো ধারণা থেকে কৃষকদের বেরিয়ে আসতে হবে। আর হালি চারা নিয়ে তেমন সমস্যা হবে না। এক গ্রামে নষ্ট হলে আরেক গ্রামে চারা পাওয়া যাবে।’