সুন্দরবনের সিন্ধু ইগল

সুন্দরবনের কটকা বন বিট এলাকায় উড়ন্ত সিন্ধু ইগল l ছবি: লেখক
সুন্দরবনের কটকা বন বিট এলাকায় উড়ন্ত সিন্ধু ইগল l ছবি: লেখক

সুন্দরবন। ছোট্ট লঞ্চ রাত সাড়ে আটটা নাগাদ কটকা খালে নোঙর করল। ভোরে উঠে সাতজনের দল নিয়ে ছোট্ট নৌকায় করে জামতলা খালে ঢুকলাম। এটাই বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্রসৈকত, যেখানে সুন্দরবনের রাজা বাঘ হেঁটে বেড়ায়। ঘণ্টা দেড়েক ঘোরাঘুরি করে বেশ কিছু বিরল ও দুর্লভ পাখির সন্ধান পেলেও চার বছর আগে দেখা সাদাকালো সেই পাখিটি চোখে পড়ল না। জামতলা ঘাটে নৌকা ভেড়ালাম। জামতলার উঁচু টাওয়ারে উঠলাম। ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারকে দুরবিন বানিয়ে চারদিকটা ভালোভাবে দেখলাম। নাহ্‌, কোথাও নেই। টাওয়ার থেকে নেমে জামতলা সমুদ্রসৈকতে এলাম। সেবার এখান থেকেই পাখিটাকে আকাশে উড়তে দেখেছিলাম। বিট অফিসের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবাই একত্র হওয়ার অপেক্ষায় আছি। মিনিট পাঁচেক পর নীল আকাশে স্বপ্নের ডানা মেলে একটি বড় পাখিকে উড়তে দেখলাম। মনটা খুশিতে নেচে উঠল। ক্যামেরায় ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। সামান্য সময় দিয়েই পাখিটি দূর আকাশে মিলিয়ে গেল।

এরা হলো এ দেশের দুর্লভ এক আবাসিক পাখি সিন্ধু ইগল। সাদা ইগল বা সাদা সাগর ইগল নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম White-bellied Sea Eagle বা White-bellied Fish Eagle। Accipitridae পরিবারভুক্ত ইগলটির বৈজ্ঞানিক নাম Halaeetus leucogaster

সিন্ধু ইগল খুবই সুন্দর পাখি। দৈর্ঘ্য ৬৬-৯০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১.৮-৪.৫ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও আকারে স্ত্রী কিছুটা বড়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা, গলা, বুক, পেট ও দেহতল ধবধবে সাদা। ডানা, পিঠ ও লেজের গোড়া কালচে-ধূসর। বড়শির মতো বাঁকা ঠোঁটটি গাঢ় ধূসর। পা ও আঙুল ধূসরাভ-সাদা, কিন্তু নখ কালচে।

সিন্ধু ইগল সুন্দরবনসহ উপকূলীয় শ্বাসমূলীয় (Mangrove) বনের পাখি। সুন্দরবনেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় দেখা যায়। একাকী বা জোড়ায় থাকে। সচরাচর নদী বা খালের ওপর ঝুলে থাকা গাছের ডাল বা আকাশে উড়ন্ত অবস্থা থেকে চমৎকার ভঙ্গিমায় ডাইভ মেরে পানি থেকে সাপ, গুইসাপ, মাছ ইত্যাদি শিকার করে খায়। এ ছাড়া কাঁকড়া, ইঁদুর, অন্যান্য প্রাণী ও পাখি শিকার করে।

অক্টোবর-জানুয়ারি প্রজননকাল। এ সময় সমুদ্র-নদী-খালপাড়ের উঁচু গাছের মগডালে ডালপালা, ঘাস, আগাছা ও পাতা দিয়ে মাচানের মতো ১.২-১.৫ মিটার চওড়া ও ০.৫-১.৮ মিটার গভীর বাসা বানায়। একই বাসা এরা বছরের পর বছর ব্যবহার করতে পারে; প্রতিবছর কিছুটা মেরামত করে নেয় মাত্র। স্ত্রী গড়ে দুটি সাদা ডিম পাড়ে, যা ফোটে ৩৬-৪২ দিনে। মূলত স্ত্রীই ডিমে তা দেয়, তবে স্ত্রী খেতে গেলে পুরুষ তা দেওয়ার দায়িত্ব নেয়। বাচ্চাগুলো ৬৫-৭০ দিনে বড় হয় ও নীল আকাশে স্বপ্নের ডানা মেলে। এরা প্রায় ১৫ বছর বাঁচে।