মত প্রকাশের জন্য ভালো, মিথ্যা তথ্যের জন্য খারাপ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় দিতে গিয়ে পত্রিকা ও বই পড়া, মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করায় তরুণেরা এখন কম সময় দিচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম এসব মাধ্যমের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। তাই এগুলোর কারণে তরুণ জনগোষ্ঠীর ভুল পথে চলে যাওয়ার আশঙ্কাটা যতটা বেশি ভাবা হয়, আসল অবস্থা ততটা খারাপ নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ভালো-মন্দ দিক সম্পর্কে প্রথম আলোর জরিপে তরুণেরা এমনটা জানিয়েছে।

তরুণেরা মনে করে, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংবাদ ও তথ্যপ্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা বিষয়টির পক্ষে ইতিবাচক মতামত দিয়েছে। তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশ, মতবিনিময়, আলোচনা-সমালোচনার জন্য তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ৯৫ শতাংশ তরুণ মতপ্রকাশের এই স্বাধীনতার বিষয়টিকে এসব মাধ্যম ব্যবহারের অন্যতম ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখে।

তরুণদের মতে, পরিচিত মানুষ, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দেশের বাইরে থাকা পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রবাসজীবনের গল্পগুলো জানতে এসব মাধ্যমের গুরুত্বের কথা জানিয়েছে ৯৪ শতাংশ তরুণ। আবার ৯১ শতাংশের মতে, দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা পুরোনো কোনো বন্ধুকে খুঁজে পেতে দারুণ কার্যকর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর ইচ্ছা থাকলেও ঘনিষ্ঠ অনেক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না অনেকের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুরোনো বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনার সেতুবন্ধ হিসেবে এখন কাজ করছে।

সমাজে সংঘটিত কোনো অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্বের কথা জানিয়েছে ৬২ শতাংশ তরুণ। আবার জরুরি প্রয়োজন, বিপদ-আপদে সহযোগিতা পেতেও এই মাধ্যমটি দারুণ কার্যকর। যেমন জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দরকার হলে রক্তদাতা খুঁজে পেতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো খুবই সহায়ক ভূমিকা রাখে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের খারাপ দিকগুলোও জরিপে তুলে ধরেছে তরুণেরা। তাদের মতে, এসব মাধ্যমে অনেক সময় ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়। বিষয়টিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে মনে করে ৯০ শতাংশ তরুণ। আবার মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়ার যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ৮৫ শতাংশ তরুণ।

পড়ালেখার ক্ষতি ও খেলাধুলায় কম সময় দেওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নেতিবাচকভাবে ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করে তরুণেরা। ফেসবুক বা ইউটিউবে বেশি সময় দেওয়ার কারণে অনেকে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ছে, এমনটা মনে করে ৮৫ শতাংশ তরুণ। আর খেলাধুলায় কম সময় দেওয়ার কথা জানিয়েছে ৬৪ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়া সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে অতিথিদের সঙ্গে কথা না বলা, পরিবারের সদস্যদের কম সময় দেওয়া, অন্তর্মুখী চরিত্রের হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো এসব মাধ্যম ব্যবহারের ফলে বাড়ছে বলে তরুণেরা মনে করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নেতিবাচক দিক নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের রয়াল সোসাইটি ফর পাবলিক হেলথের এক গবেষণা অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার তরুণ প্রজন্মের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনলাইন হয়রানি বা সাইবার বুলিং, তথ্য চুরি, বাজে ছবি বা ভিডিও প্রকাশের মতো ঘটনা তরুণদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের আরেক গবেষণায় বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে সন্তানদের নৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বেশির ভাগ অভিভাবক মনে করেন। এগুলোর অতি ব্যবহার নিয়ে তাই অভিভাবকেরা বেশ চিন্তিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে সমাজে যে একটা পরিবর্তন ঘটেছে, এটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। তরুণদের এসবের ব্যবহার থেকে আটকে রাখা যাবে না। তবে ভালো-মন্দের পার্থক্যটা যাতে তারা বুঝতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য পরিবারকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।

আরও পড়ুন: