ফেসবুকই সবচেয়ে পছন্দ

দেশের তরুণদের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চে সারা দেশে জরিপ করেছে। এতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, পারিবারিক মূল্যবোধ, অবসরে কী করে, সে বিষয়েও তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। আজ ছাপা হলো জরিপের শেষ পর্ব

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে দেশের তরুণ প্রজন্মের নির্ভরতা বাড়ছে। মতামত প্রকাশ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, দেশ-বিদেশের খবর, বিনোদন, কেনাকাটাসহ যাপিত জীবনের সবকিছুর জন্য তরুণেরা এখন নির্ভর করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণদের পছন্দের শীর্ষে আছে ফেসবুক। শীর্ষ পাঁচে থাকা অন্য মাধ্যমগুলো হলো ইমো, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবার।

প্রথম আলোর উদ্যোগে পেশাদার জরিপ সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চের এক জরিপে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ তরুণের মতামতের ভিত্তিতে জরিপটি তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ৪৯৪ জন। তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা সামাজিক যোগাযোগের কোন মাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। উত্তরে এসব মাধ্যম ব্যবহারকারী ৯৫ শতাংশ বলেছে, ফেসবুক তাদের প্রথম পছন্দ। বয়স, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ছেলেমেয়ে—সবার পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে আছে ফেসবুক। এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম গৃহবধূরা। এই শ্রেণির ৬৫ শতাংশের কাছে ফেসবুক জনপ্রিয়।

ফেসবুক বাংলাদেশের তরুণদের কাছে কতটা জনপ্রিয়, সেটা জরিপের আরেকটি পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা যায়। উত্তরদাতা ১ হাজার ২০০ তরুণের মধ্যে ৪৯৪ জন জানিয়েছে, তাদের যেকোনো একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে। এর মধ্যে ৪৬৮ জনেরই ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট আছে, যা মোট ব্যবহারকারীর ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ, এ দেশের তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার বলতে মূলত ফেসবুককেই বোঝে।

বাংলাদেশে কত লোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়মিত ব্যবহার করে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের হিসাবে, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। সরকারি হিসাবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যত অ্যাকাউন্ট আছে, তার ৯৯ শতাংশই ফেসবুককেন্দ্রিক।

বাংলাদেশের মতো সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় ফেসবুক। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতি মাসে ২০০ কোটি লোক এই মাধ্যম ব্যবহার করে। ফেসবুক ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এত বেশি ব্যবহারকারী নেই। ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটাসের হিসাব অনুযায়ী, এশিয়ায় ফেসবুকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এই মাধ্যম ব্যবহারকারী প্রতি তিনজনের একজনই এই মহাদেশের বাসিন্দা।

জরিপ অনুসারে, ফেসবুকের পরে তরুণদের পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে অ্যাপভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম ইমো। উত্তরদাতা ৫৭ শতাংশ তরুণ নিয়মিত এটি ব্যবহার করে। দেশে ও দেশের বাইরে মুঠোফোনে কথা বলা, ভিডিও কল, লাইভ চ্যাটের জন্য ইমো ব্যবহার হয়। দেশে তিনটি শ্রেণির কাছে ইমো বেশি জনপ্রিয়। তাঁরা হলেন ব্যবসায়ী, গৃহিণী ও বেকার। ইমোর ব্যবহার বরিশাল ও রংপুর বিভাগে তুলনামূলকভাবে কম, যথাক্রমে ২৪ ও ১৯ শতাংশ।

বাংলাদেশি তরুণদের তৃতীয় পছন্দ ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট ইউটিউব। জরিপের তথ্য বলছে, ৩৩ শতাংশ তরুণ নিয়মিত ইউটিউব ব্যবহার করে। গ্রামের চেয়ে শহুরে তরুণদের কাছে এই সাইটটি বেশি জনপ্রিয়। আবার মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা ইউটিউব বেশি পছন্দ করে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের তরুণেরা এই মাধ্যমটি বেশি দেখে। এ দুই বিভাগে এর ব্যবহারের হার ৪০ শতাংশ। ইউটিউব সবচেয়ে কম দেখা হয় বরিশাল ও রংপুর বিভাগে। এ দুই বিভাগে এটি ব্যবহারের হার ১০ থেকে ১১ শতাংশ। গৃহিণীরাও ভিডিও দেখার এই মাধ্যমটি কম পছন্দ করেন।

মুঠোফোনভিত্তিক আরেক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ বর্তমান প্রজন্মের পছন্দের ৪ নম্বরে আছে। বিশেষ করে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের তরুণদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপ বেশি জনপ্রিয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ সিলেট ও চট্টগ্রামের হওয়ায় অ্যাপটির ব্যবহার এসব অঞ্চলে বেশি। কারণ এটি দিয়ে খুব অল্প খরচে ফোন বা ভিডিও কল করা যায়।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, তরুণদের পছন্দের তালিকার ৫ নম্বরে রয়েছে ভাইবার। মুঠোফোনভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনটির ব্যবহার যদিও এর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের তুলনায় অনেক কম, মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের একাধিক পছন্দ থাকায় হিসাবে তা ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

ট্র্যাক এক্স নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় আছে ২৮০ কোটি মানুষ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ। এই ব্যবহারকারীদের ২৮ শতাংশ একটি মাত্র সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। দুটি মাধ্যম ব্যবহার করে ২৪ শতাংশ, তিনটি ১৬ শতাংশ, চারটি ৮ শতাংশ ও পাঁচটি মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ শতাংশ।

প্রতিষ্ঠানটির ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ডেমোগ্রাফিকস ২০১৭’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেসবুকই এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। শীর্ষ পাঁচে এর পরে আছে যথাক্রমে ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, পিন্টারেস্ট। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে ব্যবহারকারী বাড়ছে ইনস্টাগ্রামের। এটি এখন ফেসবুকের একটি সহযোগী মাধ্যম। এতে শুধু ছবি দেওয়া যায়, এটির ব্যবহারকারী বর্তমানে ৬০ কোটি। পশ্চিমা বিশ্বে ইনস্টাগ্রামের জনপ্রিয়তা বাড়লেও বাংলাদেশে এটি এখনো তেমন জনপ্রিয় নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ফাহিম মাশরুর তরুণদের এসব পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, একটি বই পড়ে শেষ করতে যে সময় লাগে, বর্তমান প্রজন্ম তার চেয়ে বেশি সময় ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে। এতে তরুণদের চিন্তার গভীরতা কমে যাচ্ছে। এই সবকিছুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সামাজিক অস্থিরতা, অন্যের মত সহ্য করতে না পারা বা জঙ্গিবাদের মতো বিষয়গুলো বাড়ছে।

তাহলে সমাধান কী জানতে চাইলে ফাহিম মাশরুর বলেন, এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে খুব সহজ কোনো সমাধান নেই। প্রযুক্তি যাতে তরুণদের চিন্তা-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বই পড়া, খেলাধুলা করার মতো সুস্থ বিনোদনচর্চার জায়গাগুলো তরুণদের করে দিতে হবে।

কোন মাধ্যমে কত সময়

তরুণেরা জানিয়েছে, সারা দিনে তারা গড়ে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে ফেসবুকে। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দৈনিক গড়ে ৫২ মিনিট সময় দেয়। এর মধ্যে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় দেয় ৮০ শতাংশ, বাকি ২০ শতাংশ ১ ঘণ্টার বেশি সময় দেয়।

সার্বিক জনপ্রিয়তায় তৃতীয় স্থানে থাকলেও সময় দেওয়ার হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউটিউব। তরুণেরা ইউটিউব দেখতে দৈনিক গড়ে ব্যয় করে ৪২ মিনিট সময়। এই মাধ্যমে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় দেয় ৯৭ শতাংশ, ১ ঘণ্টার বেশি সময় দেয় মাত্র ৩ শতাংশ। এ ছাড়া ইমোতে ৩১ মিনিট ও হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিদিন গড়ে ২৪ মিনিট সময় ব্যয় করে তরুণেরা।

সারা বিশ্বেই তরুণ প্রজন্মের বেড়ে ওঠা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসার একসঙ্গে ঘটছে। আর একই সঙ্গে পরস্পরের ওপর নির্ভরতাও বাড়ছে। এর ভালোমন্দ দুটি দিক নিয়েই এখন সারা বিশ্বে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এরই প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরতার ধরন ও মাত্রা বুঝতেই এই জরিপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আর অস্বীকার করা যাবে না। তবে এর ভালো-মন্দ দিক নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে স্কুল ও অভিভাবকদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।