একের পর এক ধর্ষণের অভিযোগ

বগুড়ায় সরকারদলীয় এক নেতার হাতে ছাত্রী ধর্ষণ এবং পরে মাসহ ওই ছাত্রীকে নির্যাতনের ঘটনায় মানুষের বিহ্বলতা কাটার আগেই দেশের পাঁচটি জেলায় ধর্ষণের আরও পাঁচটি নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। গত চার দিনে এসব ঘটনা ঘটে।

ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় শরীয়তপুরে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর (১৬) আত্মহত্যার অভিযোগ উঠেছে। টাঙ্গাইলে এক তরুণীকে (১৭) প্রায় সাত মাস নির্জন ঘরে আটকে রেখে ধর্ষণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজধানীতে আপন ফুফার হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বাক্প্রতিবন্ধী এক অন্তঃসত্ত্বা তরুণী (২০)। রাজশাহীতে দুই ‘ফেসবুক বন্ধুর’ হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্রী (২৬)। এ ছাড়া গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে আসার পথে চলন্ত ট্রাকে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।

এই পাঁচটি ঘটনার মধ্যে তিনটিতে একটি কলেজের শিক্ষকসহ পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকি দুটি ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘ধর্ষণের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, মনে হচ্ছে আমরা দিন দিন ভয়ংকর
পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ফলেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ক্ষমতার দম্ভ দেখানোর জন্যও ধর্ষণকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলেই বগুড়ার কিশোরীকে ধর্ষণের পর মা ও কিশোরী মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে অপরাধীদের। অর্থবিত্ত আছে বলেই আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে ধর্ষণ করতে পেরেছে।’ তিনি বলেন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ মামলার বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে অপরাধীদের।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ বলেন, যারা ধর্ষণের মতো অপরাধ করছে, তারা বিকৃত মানসিকতার। তারা কোনোভাবেই সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। শিশু একা থাকল কি না বা কার সঙ্গে মিশছে, তা অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে।

ছয় মাস আটকে রেখে ধর্ষণ

টাঙ্গাইলের সখীপুরে এক তরুণীকে ৬ মাস ১৭ দিন ধরে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আটকে রেখে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে। গত রোববার রাতে স্থানীয় লোকজন ঘরের তালা ভেঙে ওই তরুণীকে উদ্ধার করে। পুলিশ সোমবার সকালে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে।

এ ঘটনায় মেয়েটির ভাই বাদী হয়ে মো. বাদল মিয়া নামে একজনকে আসামি করে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন। বাদল মিয়া নিজেকে জয়বাংলা লীগ নামে একটি সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক।

সখীপুর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি খলিলুর রহমান জানান, জয়বাংলা লীগ বলতে টাঙ্গাইলে কিছু নেই। বাদল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কেউ নন।

গতকাল বুধবার রাতে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তরুণীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি বলেন, বাদল মিয়া তাঁকে তাঁর প্রেমিকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন। বাদলের কথামতো তিনি তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন। পরে তিনি বাদলের ফাঁদে আটকা পড়েন।

টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের চিকিৎসক সাইফুর রহমান জানান, মেয়েটি দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকায় শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মানসিকভাবেও তিনি অসুস্থ। আজ বৃহস্পতিবার তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করা হবে।

সখীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোতালেব মিয়া জানান, বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাকছুদুল আলম বলেন, মেয়েটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সুস্থ হলে সবকিছু জানা যাবে।

স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা

স্কুলে যাতায়াতের পথে এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল শরীয়তপুরের দশম শ্রেণির ওই ছাত্রীর। পরে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে অভিযুক্ত যুবক আফজাল ব্যাপারী তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেছে ছাত্রীটির পরিবার।

প্রথম আলোর শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, অভিযুক্ত মেয়ে ও যুবকের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলায়। এ ঘটনায় মেয়েটির বোন অভিযুক্ত আফজাল ও তাঁর বাবা সেকান্দার ব্যাপারীকে আসামি করে মামলা করেছেন। মেয়েটির মৃত্যুর পর থেকে আফজাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা পলাতক রয়েছেন।

গ্রামবাসী ও মামলার অভিযোগের বরাত দিয়ে সখীপুর থানা-পুলিশ জানায়, গর্ভধারণের সাত মাস পর আফজালকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় চাপ দেয় মেয়েটি। কিন্তু আফজাল বিয়ে করবেন না বলে জানিয়ে দেন এবং তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন। ক্ষোভে-অপমানে গতকাল বুধবার ভোররাতে মেয়েটি ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

মামলার বাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা নেই। আমরা গরিব মানুষ। ছোট বোনের সঙ্গে যে অন্যায় করা হয়েছে, তার বিচার চাইতে আমরা অনেক জায়গায় গিয়েছি। কেউ এগিয়ে আসেনি। মনের দুঃখে বোনটি আত্মহত্যা করল। আমার বোনের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুরুল হক আকন্দ বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ফেসবুকে বন্ধু সেজে ধর্ষণ

এদিকে রাজশাহীর একটি গেস্টহাউসে গত সোমবার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় পুলিশ রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মচমইল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক সামশুল আলম (৩০) ও তাঁর বন্ধু আবু ফায়েজকে (২৬) গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের দুজনের বাড়িই রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। তাঁরা শহরের বোয়ালিয়া থানার সাগরপাড়া এলাকায় থাকেন। মঙ্গলবার ভোরে আটক দুই বন্ধুকে ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিকেলে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

নগরের শাহ মখদুম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার আলী জানান, ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। কলেজশিক্ষক সামশুল আলমের সঙ্গে তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয়। চিকিৎসার জন্য ওই ছাত্রী গত সোমবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। চিকিৎসা শেষে দুপুরে তিনি সামশুলকে ফোন দেন। সামশুল তাঁকে তাঁর বন্ধু আবু ফায়েজের কম্পিউটারের দোকানে ডেকে নেন। এরপর দুপুরে খাবারের কথা বলে প্রাইভেট কার যোগে গ্রিন গার্ডেন ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড গেস্টহাউস নামের একটি বাগানবাড়িতে নিয়ে যান ওই ছাত্রীকে। সেখানে একটি কক্ষে রেখে দুজন মিলে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন। সন্ধ্যায় ছাত্রীটিকে হোটেলে ফেলে রেখে চলে যান তাঁরা। রাত আটটায় পুলিশ ঘটনাটি জানার পর একটি ধর্ষণ মামলা করে রাতেই অভিযান শুরু করে। মঙ্গলবার ভোরে অভিযুক্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শাহ মখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিল্লুর রহমান জানান, গতকাল বুধবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বিকেলে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। গ্রেপ্তারকৃত দুজনকে আজ বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে।

চলন্ত ট্রাকে ধর্ষণের শিকার কিশোরী

গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার পথে চলন্ত ট্রাকে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বুধবার সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল এসিআই এলাকা থেকে ওই কিশোরীকে এলাকাবাসীর সহায়তায় উদ্ধার করে পুলিশ ডাক্তারি পরীক্ষা করার জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া) পাঠিয়েছে। রাতে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকা থেকে অভিযুক্ত ট্রাকচালক মেহেদী হাসানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরীর বরাত দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সাত্তার জানান, ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বাড়ি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানায়। মঙ্গলবার বিকেল চারটার দিকে তার মায়ের সঙ্গে অভিমান করে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। রাত আটটার দিকে গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকা থেকে তাকে একটি ট্রাকের চালক ও হেলপার তাঁদের পণ্যবাহী ট্রাকে (ঢাকা-মেট্রো ট-০২-০৩৪৪) তুলে নেয়। বুধবার সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলের এসিআই এলাকায় ট্রাক থেকে কিশোরীর কান্নার শব্দ শুনে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসে। এ সময় চালক ও হেলপার ট্রাক ফেলে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে ওই কিশোরীকে উদ্ধার এবং ট্রাকটি আটক করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়।

ওসি আবদুস সাত্তার জানান, এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

ধর্ষণের শিকার বাক্প্রতিবন্ধী তরুণী

পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় মঙ্গলবার বাক্প্রতিবন্ধী এক অন্তঃসত্ত্বা তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় ওই তরুণীর ফুফাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় তরুণীর বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন।

চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম অর রশীদ তালুকদার বলেন, ২০ বছর বয়সী ওই তরুণীর বাবা পেশায় রিকশাচালক। একই বাসায় তরুণীর ফুফাও থাকেন। প্রতিদিন সকালে পরিবারের সদস্যরা সবাই নিজের কাজে বেরিয়ে যান। এই সুযোগে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে তরুণীকে ধর্ষণ করে আসছিলেন। এতে তরুণীটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তরুণীর ফুফা অভিযোগ স্বীকার করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার তাঁকে আদালতে পাঠানো হবে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণসহ যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রে সরকার কঠোর। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘটনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এ ধরনের অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে, মামলার সংখ্যা বাড়ছে। আলোচিত মামলাগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর ফলে তদন্তসহ সব প্রক্রিয়া দ্রুত হচ্ছে।

রাশেদা কে চৌধূরীর মতে, মাদক, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলেই ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষণের ঘটনায় পরিবার, সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থাসহ নানান বিষয়কে দায়ী করাই যায়। তবে শেষ বিচারে দায়ভার নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। দেশে আইন বা আইনি কাঠামোর কমতি নেই। এখন প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ।