সর্বত্র আলোচনা, সরকার নিশ্চুপ

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সরকারে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তাঁর পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে কড়া সমালোচনা করলেও সরকারের কোনো পর্যায় থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি।

সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে সরকার অনেকটাই বিব্রত। এ নিয়ে নেতা বা মন্ত্রীদের মুখ না খুলতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি দলের একাধিক নেতা এই রায়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ দেশের সামগ্রিক বিভিন্ন বিষয় রায় ও পর্যবেক্ষণে আনা দরকার ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দলের নীতি হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে জোরালো আলোচনা করা। গত ৩ জুলাই সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের পর সংসদ অধিবেশনে বিষয়টি নিয়ে কড়া সমালোচনা হয়। সে সময় সমালোচনায় অংশ নেওয়া একজন সাংসদ প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে সংসদেই কথা বলবেন। আগামী সেপ্টেম্বরে সংসদের পরবর্তী অধিবেশন বসলে সেখানেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।

গতকাল বুধবার যোগাযোগ করা হলে আইন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এখনই এ বিষয়ে কথা বলবেন না।

সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তবে আইনজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকেই বিষয়টি স্পর্শকাতর বিবেচনায় এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি।

গত মঙ্গলবারের পূর্ণাঙ্গ রায় অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরছে। বর্তমান সরকারের সময়ে এই ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে দিতে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল।

মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এমন একটি পঙ্গু সমাজে আমরা আছি, যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না, কিন্তু খারাপ লোকেরা আরও লুটপাটের জন্য বেপরোয়া।’ তিনি বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার মতো কোনো নজরদারি বা তদারককারী প্রতিষ্ঠান নেই। এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষারও ব্যবস্থা নেই। নির্বাহী দাম্ভিক নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় আমলাতন্ত্র কখনোই দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হবে না।’ তাঁর মতে, মেধা নয়, ক্ষমতার মাধ্যমেই এখন দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

সামরিক শাসনামলের সমালোচনা করে রায়ে বলা হয়, ‘ক্ষমতালোভীরা দুবার আমাদের রাষ্ট্রকে “ব্যানানা রিপাবলিকে” পরিণত করেছিল, যেখানে ক্ষমতালোভীরা তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জনগণকে পণ্যরূপে দেখেছে, ধোঁকা দিয়েছে। তারা জনগণের ক্ষমতায়ন করেনি, অপব্যবহার করেছে। তারা নানা রকম ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। কখনো ভোটের নামে, কখনো জোরপূর্বক নির্বাচনের মাধ্যমে, কখনো নির্বাচন না করে। এর সবটাই করা হয়েছে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে। আর এর মধ্য দিয়েই সুস্থ ধারার রাজনীতি পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এসব অগণতান্ত্রিক শাসনামলের নোংরা রাজনীতির চর্চা আমাদের সার্বিক জনরাজনীতিকে মারাত্মক ক্ষতি করেছে।’

প্রধান বিচারপতির এই অংশের বক্তব্যের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পর্যবেক্ষণের বক্তব্য আমারও। সুতরাং এ বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রায় সবই ঠিক আছে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, এখন রাজনীতি মুক্ত নয়। এটি বাণিজ্যিক বিষয়। আর অর্থ রাজনীতি পরিচালনা করে। আর সেটিই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দেয়। এখন মেধা নয়, ক্ষমতাই সব জনপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী।

এ প্রসঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-উর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, এখানে রাজনীতির বিষয়টি অনেক বেশি সরলীকরণ করা হয়েছে। সবকিছুর মধ্যেও রাজনীতির নিজস্ব ধারা অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, রাজনীতিতে বিত্তের প্রভাব বেড়েছে, ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণও বেড়েছে, এটা সত্য। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি এবং বিএনপির নেতৃত্বে আরেকটি শক্তির রাজনীতির মূলধারা কিন্তু বহমান।

পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি তাঁর হতাশার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিরোধের স্পৃহার মাধ্যমে আমরা সামরিক শাসনের থাবা থেকে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু পরাজিত হয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্রে। এমনকি স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা আমাদের একটি জনপ্রতিষ্ঠানকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। কোথাও আমাদের ভারসাম্য নেই। তদারককারী নেই। আর এ কারণেই সুবিধাভোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহারে উৎসাহিত হন এবং যত্রতত্র ক্ষমতার অপব্যবহারের ধৃষ্টতা দেখান। রাষ্ট্রক্ষমতার যা রাজনৈতিক ক্ষমতার আরেক রূপ, সাম্প্রতিক সময়ে তা গুটিকয়েক মানুষের একচ্ছত্র বিষয়ে পরিণত করেছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণের আত্মঘাতী প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতার লিপ্সা মহামারির মতো, যা একবার ধরলে তা দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দ্বার্থ্যহীন কণ্ঠে বলতে চাই, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন, কোনো ক্ষমতাধর দৈত্যের জন্য নয়।’

অধ্যাপক হারুন বলেন, পূর্বপুরুষেরা আগে যে রাজনীতি করেছেন, এখনকার রাজনীতি তেমনই হবে, এটা ভাবার কারণ নেই। এখনকার রাজনীতি উন্নয়নের রাজনীতি। তা ছাড়া বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক রাজনীতির দিকে তাকালেও দেখা যায়, সেখানেও রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে নানা পরিবর্তন এসেছে।

প্রধান বিচারপতি তাঁর বক্তব্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে কথা বলেন। তিনি মত দেন, নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে এবং কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে না হতে পারলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গ্রহণযোগ্য সংসদ প্রতিষ্ঠা হয় না।

নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কোনো সরকারের সময়ে এমনকি বর্তমান সরকারের সময়েও নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারেনি। এর ফলে ইসির টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন হয়নি। তাঁর মতে, ইসিকে সহায়তার পরিবর্তে এর ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হয়। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ২০১৪ সালের নির্বাচন, যেখানে বড় রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হলে এটা হতে পারত না।

প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা। আর প্রযুক্তির উন্নতির সহায়তা নিয়ে অপরাধের প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম নয়। এমন পরিস্থিতে নির্বাহী বিভাগ আরও অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং আর আমলাতন্ত্র দক্ষতা অর্জনে চেষ্টাহীন।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মুখে বিচার বিভাগই তুলনামূলকভাবে স্বাধীন অঙ্গ হিসেবে কাজ করছে, ডুবতে ডুবতে নাক উঁচিয়ে বেঁচে থাকার মতো। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগও খুব বেশি দিন টিকে থাকবে না। এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতের বিচারকদের নির্বাচন ও নিয়োগের কোনো আইন হলো না। নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা সংকুচিত করতে আগ্রহী। আর যদি তা হয় তাহলে এর চেয়ে ধ্বংসাত্মক আর কিছু হবে না।

রায়ে বলা হয়, ‘বিচারক অপসারণের ক্ষমতা যদি সংসদ সদস্যদের হাতে যায়, তবে তার প্রভাব বিচার বিভাগে পড়বে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া দীর্ঘদিন সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থা অনুপস্থিত থাকায় প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যদি কোনো একজন বিচারকের তাঁর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছে জবাবদিহি না থাকে, তবে ওই বিভাগ ধসে পড়তে বাধ্য।’

১১৬ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গ

প্রধান বিচারপতি রায়ে বলেছেন, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে সংশোধন আনা হয়, যাতে ‘সুপ্রিম কোর্টের’ স্থলে ‘প্রেসিডেন্ট’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরতদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির নিয়ন্ত্রণ প্রেসিডেন্টের কাছে ন্যস্ত করা হয়। এ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদিও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান রাখা হয়েছে, তথাপি তা অর্থহীন যদি নির্বাহী বিভাগ সুপ্রিম কোর্টকে সহযোগিতা না করে। তার ওপর এই অনুচ্ছেদ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। যেখানে বলা হয়েছে, অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাইকোর্ট বিভাগের হাতে থাকবে। আরও বলা হয়েছে, অ্যাটর্নি জেনারেল এটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে চতুর্থ সংশোধনীর আগে অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাইকোর্ট বিভাগের হাতে ছিল এবং এ বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের স্থানে প্রেসিডেন্ট শব্দ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা পুরোটাই সংকুচিত করা হয়েছে এবং বাদ দেওয়া হয়েছে।

ঐতিহাসিক রায়: বিএনপি

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো মনে করি ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ রায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি একটি ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী রায়।’

ফখরুল বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে প্রমাণ হয়েছে, বর্তমান সরকার একটি একনায়কতান্ত্রিক সরকার। এই সরকার সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছে। সংসদকে অকার্যকর করে রেখেছে। কোনো একটি সভ্য দেশের আদালত যদি এই রায় দিতেন, তাহলে এতক্ষণে সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যেত। এই রায়ের পর বর্তমান সরকারের আর ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়।