দশ বছরে কেবল ইটের গাঁথুনি, মেলেনি ফ্ল্যাট

ভাষানটেক প্রকল্পের কিছু এলাকার বর্তমান চিত্র। ছবি: প্রথম আলো
ভাষানটেক প্রকল্পের কিছু এলাকার বর্তমান চিত্র। ছবি: প্রথম আলো

স্বপ্নের ফ্ল্যাটের জন্য ২০০৭ সাল থেকে এখানে-সেখানে ঘুরছেন হারুনূর রশিদ। ফ্ল্যাট পাওয়ার জন্য দফায় দফায় টাকা দিয়েছেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন দিনের পর দিন। এখনো ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হয়নি। যে ফ্ল্যাটে তিনি পরিবার নিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেছেন, এখন সেখানে কেবল ইটের গাঁথুনি। অযত্নে আর অবহেলায় পলি জমেছে দেয়ালে দেয়ালে। তিনি জানেন না কবে উঠতে পারবেন ফ্ল্যাটে। যেন একরাশ হতাশা ঝরে পড়ল তাঁর কণ্ঠে।

রাজধানীর ভাষানটেকে ‘ঢাকা মহানগরীর বস্তিবাসী ও নিম্নবিত্তদের ঢাকায় সরকারি জমিতে বহুতলবিশিষ্ট ভবনে পুনর্বাসন প্রকল্পের’ (ভাষানটেক প্রকল্প) ১ হাজার ২৯৬ জন আবেদনকারী এখনো তাঁদের ফ্ল্যাট বুঝে পাননি। এ নিয়ে তাঁরা হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। আবেদনকারীদের অভিযোগ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্পের কাজ ১০ বছরে শেষ হয়নি। অনতিবিলম্বে তাঁরা এটির সমাধান চান।
২০০৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে পাঁচ বছরে মোট ১৩ হাজার ৬৬০টি ফ্ল্যাট তৈরির কথা ছিল। কিন্তু নয় বছরে হয়েছে ২ হাজার ১৬টি ফ্ল্যাট। প্রকল্পে সরকারের দেওয়া ৪৭ দশমিক ৯০ একর জমিতে ১১১টি ভবন তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১৮টি। অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে ১২টি ভবন। এই প্রকল্পে বস্তিবাসীদের জন্য ২১৫ বর্গফুট এবং নিম্নবিত্তদের জন্য ৩৯৫ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট নির্মিত হয়েছে।
সরেজমিনে ভাষানটেক প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কিছু ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হয়ে সেখানে আবেদনকারীরা উঠেছেন। কিন্তু ১ হাজার ২৯৬টি ফ্ল্যাটের কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব ফ্ল্যাটের কেবল ইটের গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময় দেওয়া এই গাঁথুনির বাইরে পুরু ঘাসের স্তর জমা হয়েছে। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে তিনটি ‘এ’ টাইপ ভবনে ৪৩২টি ফ্ল্যাট আছে আর ‘বি’ টাইপ ৯টি ভবনে ৮৬৪টি ফ্ল্যাট আছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগরীর ছিন্নমূল বস্তিবাসী ও নিম্নবিত্তদের পুনর্বাসনের জন্য ৩৯৫ বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট ১০ হাজার ফ্ল্যাটের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সরকারি জমিতে বহুতলবিশিষ্ট ভবনে এ পুনর্বাসন প্রকল্প করার পরিকল্পনা করা হয়। ২০০৭ সালে সরকার প্রকল্পের কাজ শুরু করলে ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় এ ফ্ল্যাটগুলো দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১০ সাল পর্যন্ত সেখানে কেউ কেউ ছয় লাখ, কেউ সাত লাখ, কেউ সাড়ে সাত লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। সে সময় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, লিখিতভাবে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু দেওয়া হয়নি।
ফ্ল্যাট-বঞ্চিত একজন মো. হারুনূর রশিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৭-২০১০ সাল পর্যন্ত ফ্ল্যাটের জন্য আবেদনকারীরা ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট পেতে সাড়ে সাত লাখ পর্যন্ত পরিশোধ করেন। ২০১০ সালে সরকার ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এনএসপিডিএলের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের সুসম্পর্ক না থাকায় চুক্তি বাতিল করে এবং নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এর পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে ফ্ল্যাটের জন্য টাকা পরিশোধ করা আবেদনকারীদের বলা হয় আরও ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করলে এক বছরের মধ্যে তাঁদের কাছে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু দুই বছর পার হয়ে গেলেও প্রকল্পে ফ্ল্যাট তৈরির কোনো কাজ না দেখে টাকা পরিশোধকারীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ফ্ল্যাটগুলো বুঝে পাওয়ার জন্য তাঁরা দুই বছর ধরে ভূমি মন্ত্রণালয় ও সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন।

ভাষানটেক প্রকল্পের কিছু এলাকার বর্তমান চিত্র। ছবি: প্রথম আলো
ভাষানটেক প্রকল্পের কিছু এলাকার বর্তমান চিত্র। ছবি: প্রথম আলো

আরেক ফ্ল্যাট-বঞ্চিত ফারহানা রহমান বলেন, ‘এই ফ্ল্যাট পাওয়ার জন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে। কত জায়গায় গিয়েছি তার শেষ নেই। একধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছি। আমি তো চাকরি ছেড়ে বেশি সময় দিতে পারি না। তারপরও যতটা পেরেছি করেছি। কবে ফ্ল্যাট পাব জানি না। তবে এই কষ্টের একটা শেষ হওয়া উচিত। সরকারের কাছে আবেদন, এটা যেন একটা সমাধান করে দেন তারা।’
কাজ শেষ করার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক সামস আল মোজাদ্দিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হওয়ার জন্য আমি একটি প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেখানে ওই প্রস্তাব প্রায় তিন মাস ধরে আটকে আছে। সেটি একনেকে উঠলে এর একটা সমাধান হবে।’ তিনি আরও বলেন, এটি শেষ করার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করেছেন ও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।