ইয়াবা ব্যবসায় দুই দেশের ভিআইপিরা

পুলিশ ও বিজিবির গোপন প্রতিবেদন
পুলিশ ও বিজিবির গোপন প্রতিবেদন

মিয়ানমার সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশে ইয়াবা বড়ি ব্যবসায় জড়িত। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গোপন প্রতিবেদনে এ তথ্য রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এই গোপন প্রতিবেদনে বিজিবি বলেছে, মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সংসদ ও দেশটির শান প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মংডু ও বুচিডং এলাকার সীমান্তরক্ষী, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, কাস্টমস, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাজে লাগিয়ে ইয়াবা ব্যবসা করছেন। এ জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ১৫টি স্থানে ৩৭টি কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকায় মিয়ানমার দূতাবাস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
তবে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবা নিয়ে বিজিবি খুবই উদ্বিগ্ন। কিন্তু মিয়ানমার সীমান্তে নিয়োজিত বাহিনী ‘লুনথিন’-এর সঙ্গে বিজিবি এখনো কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। এ কারণে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপও নিতে পারছে না।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজার জেলা পুলিশ, বিজিবি ও পুলিশের বিশেষ শাখার একাধিক গোপন প্রতিবেদনে ইয়াবা ব্যবসার জন্য টেকনাফের (কক্সবাজার-৪) সাংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতা আবদুর রহমান বদিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সাংসদের পাঁচ ভাই ও তাঁর স্বজনেরা ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। তাঁদের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা।
তবে সাংসদ বদি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে তিনি এবং তাঁর পরিবারের কেউ জড়িত নন। উল্টো তিনি ইয়াবাসহ পাচারকারীদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, প্রকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আড়াল করতে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে; যাতে তাঁর ভাইদের অভিযুক্ত করা যায়।
কক্সবাজারের জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের চাপে তাঁরা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। এমনকি শীর্ষস্থানীয় ১০ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা করেও তাঁরা কোনো অভিযান চালাতে পারেননি।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. আজাদ মিয়া এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইয়াবার গডফাদার হিসেবে ১০ জনের তালিকা করেছিলাম। কিন্তু গডফাদাররা তো আর সরাসরি ইয়াবা ব্যবসা করেন না। তথ্যপ্রমাণ না থাকায় তাঁদের ধরাও যাচ্ছে না। ইয়াবা বহনকারীরা গ্রেপ্তারের পর গডফাদারদের নাম বলে না।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বিজিবির গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের ইয়াবা কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে মংডু এলাকার সাবরিং ইউনিয়নে। ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল আসে থাইল্যান্ড থেকে। এসব কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াবা তৈরি হয়। এর দামও আলাদা। কারখানাগুলো চালান মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর আত্মসমর্পণকারী সদস্যরা। মিয়ানমারের ‘নাগরিত্ব আইন ১৯৮২’ অনুসারে আত্মসমর্পণের পর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্ণ নাগরিক সুবিধাসহ মিয়ানমারের সর্বত্র অবাধ চলাফেরার সুযোগ পান। তাঁদের জন্য লাল রঙের একটি বিশেষ পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এসব পরিচয়পত্রধারীই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে এসে ইয়াবা তৈরিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তবে কারখানাগুলোর নেপথ্যের মালিক মিয়ানমার সরকারের পদস্থ ব্যক্তিরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদির পাঁচ ভাই আবদুল আমিন, মোহাম্মদ ফয়সাল, শফিকুল ইসলাম, মৌলভী মুজিবুর রহমান ও আবদুস শুক্কুরের নাম রয়েছে। আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে সাংসদের ঘনিষ্ঠ।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাংসদের দুই ভাই আবদুল আমিন ও আবদুস শুক্কুর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট কিনে সপরিবারে বসবাস করেন। বাকি তিন ভাই থাকেন টেকনাফে। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ইয়াবা ডিলার জাহিদ হোসেন ওরফে জাকু বদির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। জাহিদ হোসেনের ছেলে রাফচানের নামও তালিকায় আছে। এ প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, তালিকায় নাম থাকলেও তাঁরা ইয়াবা ব্যবসা করেন না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আরও আছে পৌর কাউন্সিলর ও টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি একরামুল হক ও সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন এবং উপজেলা চেয়ারম্যান শফিক মিয়ার জামাতা নূর হোসেনের নাম। এ ব্যাপারে একরামুল হক বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি বলে একটি মহল আমার নাম ইয়াবা তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ আর নূর হোসেনের বক্তব্য, ‘মূল ব্যবসায়ীদের আড়াল করতে আমাকে জড়ানো হচ্ছে।’
তালিকায় আরও আছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, তাঁর দুই ছেলে দিদারুল আলম ও মোস্তাক আহমদ, হ্নীলার মৌলভীপাড়ার আবদুর রহমান, লেদা এলাকার দুই ভাই নুরুল হুদা ও নূর মোহাম্মদ, নাজিরপাড়ার ছৈয়দ হোসেন, সিকদারপাড়ার শামসুল আলম ওরফে বার্ম্যাইয়া শামসু ও হাবিরপাড়ার সিদ্দিক মিয়া। তাঁরা সবাই সাংসদ বদির ঘনিষ্ঠ ও আশীর্বাদপুষ্ট বলেই পরিচিত।
সূত্র জানায়, শাহপরীর দ্বীপের মো. ইসমাইল ইয়াবাসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের দুই মাস পর জামিনে বেরিয়ে আবার ইয়াবা ব্যবসায় নেমে পড়েন। আরেক ইয়াবা ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বিজিবির হাতে গ্রেপ্তারের তিন মাস পর জামিনে মুক্তি পান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফের আওয়ামী লীগের নেতা ও জিপচালক নুরুল হুদা ইয়াবা ব্যবসা করে লেদা বাজারে দোতলা আলিশান বাড়ি করেছেন। দমদমিয়া বিওপির পাশে করেছেন তিনতলা হোটেল। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে চলাচল করে তাঁর ১৯টি যাত্রীবাহী বাস। তাঁর দুই ভাই নুর কবির ও নুর মোহাম্মদ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। কিছুদিন আগে ডিবি পুলিশ ইয়াবাসহ নুর মোহাম্মদকে আটক করে। এখনো তিনি কক্সবাজার জেলা কারাগারে আছেন। তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় ১৯টি ইয়াবা মামলা আছে। এত টাকার মালিক হলেন কীভাবে—জানতে চাইলে নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই, এত টাকার মালিক আমাকে বানিয়েছেন আল্লাহ। আমি ইয়াবা ব্যবসা করি না।’