একজন 'গাছ সামাদ' অথবা 'পাগল সামাদ'
কেউ বলতেন ‘গাছ সামাদ’, কেউ বা ‘পাগল সামাদ’। রিকশা চালিয়ে যা আয় হতো, তা থেকে আগে কিনতেন একটি চারা। এরপর বাকি টাকা দিয়ে চাল, ডাল, তেল, লবণ যতটা হয়।
মানুষটার নাম আবদুস সামাদ শেখ। গত ৪০ বছর ধরে ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন সড়কের পাশে গাছ রোপণ করেছেন তিনি। পরিবার নিয়ে না খেয়ে থেকেছেন, কিন্তু পিছিয়ে যানটি গাছ লাগানোর আন্দোলন থেকে।
সেই আবদুস সামাদ শেখ আর নেই। শনিবার ভোরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি।
আবদুস সামাদ শেখের এক ছটাক জমিও নেই। থাকতেন শহরতলির ভাজনডাঙ্গা কলোনিতে, সরকারি জায়গায়। গাছ কেনার পর কখনো করতে পারেননি সামান্য বাজারটুকু।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেয় তাঁকে। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সামাদকে ঢাকা যেতে হয়। সারা দিনে একটি গাছ রোপণ করতে না পারার কষ্টের কথা জানতে পেরে পত্রিকার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম রাতে ওই সংবর্ধনাস্থলেই একটি গাছের চারা রোপণের ব্যবস্থা করে দেন।
সামাদকে নিয়ে ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, সমকালসহ বিভিন্ন পত্রিকায় একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন বের হয়েছে। এটিএন বাংলা, একুশে টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখানো হয়েছে বিশেষ প্রতিবেদন।
নানা ধরনের গাছ লাগিয়েছেন সামাদ শেখ। তবে তাঁর প্রিয় ছিল ফলের গাছ, বিশেষ করে কাঁঠালগাছ। এই ফলটি বড় পছন্দ করতেন তিনি।
অসুস্থ সামাদ গত ১ জুলাই থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরের দিন তাঁকে হাসপাতালে তাঁর নির্ধারিত শয্যাসহ কোথাও খুঁজে না পেয়ে সচকিত হয়ে ওঠেন স্বজন ও হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পরে দেখা যায়, হাসপাতালের চত্বরে একটি গাছ রোপণ করে পানি ঢালছেন সামাদ।
সামাদ লিভারের টিউমার রোগে ভুগছিলেন। এ জন্য গত ১২ জুলাই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর পেটে অস্ত্রোপচার করেন ওই হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক রতন সাহা। পরবর্তী সময়ে সেপটিসেমিয়া-সংক্রান্ত (রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়া) সমস্যায় তিনি মারা যান।
তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে ফরিদপুরের বিশিষ্টজনেরা ছুটে যান তাঁর ঘরে। গিয়েছিলেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেসাম হোসেন ওরফে বাবর, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার, আলীয়াবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামানসহ অনেকেই। সবাই সান্ত্বনা দেন শোকসন্তপ্ত পরিবারকে।
গতকাল শনিবার দুপুরে ভাজনডাঙ্গি জামে মসজিদে জানাজা শেষে ভাজনডাঙ্গা কবরস্থানে মাটির শয্যায় চিরকালের জন্য শুইয়ে দেওয়া হয় সামাদ শেখকে।
ভাজনডাঙ্গা কলোনিতে মাটির ভিতের ওপর টিনের বেড়া ও ওপরে একচালা টিন দিয়ে তৈরি ঘরে থাকতেন সামাদ। বড় ছেলে কুতুব বাবার মতোই রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছোট ছেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উমেদার হিসেবে কাজ করেন, বিনা বেতনে।
সামাদের বিধবা স্ত্রী ঝর্ণা বেগম বলছিলেন, কোনো সম্পত্তি রেখে যাননি সামাদ শেখ। একটা ছেলেকে যদি চাকরির ব্যবস্থা করা যেত, খেয়েপরে কোনো রকমে বাঁচতেন তাঁরা।
ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেসাম হোসেন বলেন, সামাদ বাড়ির বাজার না করে গাছ কিনে লাগাতেন। এ জন্য লোকে তাঁকে পাগল বলত। সামাদকে পাগল বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ ছিলেন। তিনি হৃদয় দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে পরিবেশের জন্য গাছ কত উপকারী।
সামাদ শেখরাই আমাদের সত্যিকারের নায়ক, বললেন অধ্যাপক আলতাফ হোসেন। জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির এই সদস্য বলেন, গাছ লাগানোর আন্দোলনকে যদি এগিয়ে নেওয়া যায়, তবে সত্যিকারে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।