পর্যবেক্ষণ সংশোধনই আ.লীগের লক্ষ্য

এস কে সিনহার, ওবায়দুল কাদের
এস কে সিনহার, ওবায়দুল কাদের

বাইরে রায় প্রশ্নবিদ্ধ করার রাজনৈতিক চাপ রেখে ভেতরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের পর্যবেক্ষণে আসা ‘অনভিপ্রেত’ বিষয়গুলো বাদ দেওয়াই দলটির মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে আদালত যাতে সেগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাদ দেন, এমন একটা সমাধানের পথ খুঁজছে সরকারি দল।

এই চেষ্টার অংশ হিসেবে গত শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বাসায় যান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেখানে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় অবস্থান করেন তিনি। তাঁরা দুজন একসঙ্গে রাতের খাবার খান। সরকার, আওয়ামী লীগ ও উচ্চ আদালতের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের আগে ওবায়দুল কাদের দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোনে বিষয়টি অবহিত করেন। সাক্ষাতের পর গতকাল রোববার সকালে গণভবনে গিয়ে পুনরায় প্রধানমন্ত্রীকে বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে অবহিত করেন। তবে আলোচনা কতটা ফলপ্রসূ বা দুই পক্ষ কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে কি না, এই বিষয়টি খোলাসা করেনি কোনো পক্ষই। তবে ওবায়দুল কাদেরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বৈঠক আরও হবে।

দলীয় সূত্র জানায়, আলোচনার মাধ্যমে দুটি পথের সন্ধান করছে আওয়ামী লীগ। প্রথমত, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পর্যবেক্ষণের কিছু অংশ বাদ দেওয়ার বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে রাজি করানো। নতুবা পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হলে আওয়ামী লীগের চাওয়া পূরণ হবে, এমন নিশ্চয়তা আদায় করা।

এই সমঝোতা প্রচেষ্টার বাইরে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে ও সমমনাদের দিয়ে রায়ের সমালোচনা অব্যাহত রাখবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল গতকাল আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক বৈঠকে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করে। এ বিষয়ে প্রতিটি দল নিজেদের মতো করে রায়ের বিষয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈধ সংসদ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে রায়ে যে পর্যবেক্ষণ রয়েছে, তা ১৪ দল প্রত্যাখ্যান করছে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে রায়ে যা বলা হয়েছে, তা জনগণ মেনে নেবে না, ক্ষমা করবে না। সুতরাং এ রায়ের পুনর্বিবেচনা জরুরি।’

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে গতকাল গুলিস্তানে মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের পাশে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান প্রধান বিচারপতির কাছে তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। আলোচনা আরও হবে। সময় হলে সব জানানো হবে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে নানা বক্তৃতা-বিবৃতি দিলেও ওবায়দুল কাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে দোষারোপ করছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আলোচনার পথ খোলা রেখেই সরকারি দল সবকিছু করছে।

গতকাল মিট দ্য রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তাঁদের সাক্ষাতের বিষয়ে তিনি জানেন না। তবে দেশের উন্নতির জন্য, জনগণের স্বার্থে আলাপ-আলোচনা সব সময় চালিয়ে যাবেন।

এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা টানাপোড়েন অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই হয়। আবার একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মতভিন্নতা বা মতদ্বৈধতার অবসান ঘটে। যদি এর অবসান না ঘটে এবং একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায়, তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংকটে পড়ে। এতে অগণতান্ত্রিক শক্তি সুযোগ পায়।

এদিকে আদালত সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার ওবায়দুল কাদেরের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়। তখন প্রধান বিচারপতি জানান, তিনি শুক্রবার ঢাকার বাইরে থাকবেন। শনিবার সাক্ষাৎ হতে পারে। এরপরই শনিবার রাতে সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হয়।

ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, গত জুলাইয়ে ষোড়শ সংশোধনীর রায় দেওয়ার আগে-পরে এই দুজনের একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে প্রধান বিচারপতির বাসায় গেলেন ওবায়দুল কাদের। দুই পক্ষের আগ্রহেই এই সাক্ষাৎ হয়েছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে সমালোচনার ঝড়, আরেক দিকে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ-সরকারের এই দ্বৈত ভূমিকা কাম্য নয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী তো বলেই দিয়েছেন, রায় সংশোধনের তরিকা আছে। তাহলে সে পথেই সরকারের হাঁটা উচিত।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বাতিলের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে বিচার বিভাগের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ এতটা উদ্বিগ্ন নয়। বরং রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়েই মূলত তাদের আপত্তি। এ জন্য এই পর্যবেক্ষণ বাদ দেওয়ার বিষয়েই এখন দলটির মনোযোগ।

দলীয় সূত্র আরও জানায়, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ৬ আগস্ট সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সে সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে থাকা ‘অনভিপ্রেত’ অংশ কীভাবে বাদ দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনা আওয়ামী লীগের জন্য আশানুরূপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, নেতা-সাংসদেরা প্রকাশ্যে রায় ও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে বক্তৃতা অব্যাহত রেখেছেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুবিধাজনক সময়ে এবং বিলম্ব মার্জনার মাধ্যমে করা হবে। এর মাঝে যতটা সম্ভব রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চলবে। সে ক্ষেত্রে মাঠের চাপ অব্যাহত রাখা হবে। পাশাপাশি আলোচনার পথও খোলা থাকবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রায়টি প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ আশাহত হয়েছে, বেকায়দায় পড়েছে। প্রথমদিকে রায় নিয়ে তাদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া সঠিক ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দলের নেতারা যেভাবে কথা বলছেন এবং প্রধান বিচারপতির কাছে যাচ্ছেন—এতে তাঁরা চাপ সৃষ্টি করে রায় বদলানোর চেষ্টা করছেন, এমন ধারণা তৈরি হবে, যা দলের জন্য ভালো নয়।

 অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ বলেন, অগণতান্ত্রিক শক্তি ছাড়া সবাই আলোচনার এই চেষ্টাকে স্বাগত জানাবে।