বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত

পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। তাই নৌকায় ঘরের চালা–বেড়াসহ আসবাব ও গবাদিপশু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে চলা। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের কাবিলপুর এলাকা থেকে গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো
পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। তাই নৌকায় ঘরের চালা–বেড়াসহ আসবাব ও গবাদিপশু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে চলা। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের কাবিলপুর এলাকা থেকে গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অনেক জেলায় বন্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে লাখো টাকার মাছ। তলিয়ে যাচ্ছে হাজারো একর জমির ফসল। রাস্তাঘাট ভেঙে কোথাও কোথাও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হাজারো মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র ও বাঁধে।

লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৫০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সদর উপজেলার কুলাঘাট ও মোগলহাট ইউনিয়নে অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ধরলা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ বাঁধের চারটি স্থান গত শনিবার দুপুর থেকে রাতের মধ্যে ভেঙে গেছে। লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় ২৫ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমির আমন খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ বলেন, ইতিমধ্যে বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য ১৬০ মেট্রিক টন খয়রাতি চাল ও ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ডিমলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের তিস্তা নদীবেষ্টিত প্রায় ৩০টি গ্রাম ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ১৫ সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।

বদরগঞ্জে টানা বর্ষণে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে পৌরসভার গরুহাটি এলাকা। গতকালের ছবি
বদরগঞ্জে টানা বর্ষণে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে পৌরসভার গরুহাটি এলাকা। গতকালের ছবি

ডিমলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, ইউনিয়নের পূর্ব খড়িবাড়ি ও দক্ষিণ খড়িবাড়ি গ্রামে শনিবার পর্যন্ত সাড়ে ৯০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত থাকলেও গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পরিবারপ্রতি ১০ কেজি করে চাল ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। নদীভাঙনের শিকার ২০টি পরিবারকে এক হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। পূর্ব ছাতনাইয়ের ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, পূর্ব ছাতনাই, ছাতনাইসহ ৩ গ্রামের ১ হাজার ১০০ পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাঝে ১০ কেজি করে চাল ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। খালিশা চাপানীর ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, ছোটখাতা, ডালিয়া ও বাইশপুকুর গ্রামের প্রায় তিন হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান বলেন, সাংসদ আফতাব উদ্দিন সরকার ও জেলা প্রশাসক মো. খালেদ রহীম বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

নওগাঁর মান্দার নুরুল্যাবাদ ইউনিয়নের পার নুরুল্যাবাদ এলাকায় আত্রাই নদের বাঁ তীরের বেড়িবাঁধ ও নুরুল্যাবাদ উত্তরপাড়া এলাকায় শনিবার রাতে আত্রাই নদের ডান তীরের বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে পার নুরুল্যাবাদ ও নুরুল্যাবাদ উত্তরপাড়া গ্রাম প্লাবিত হয়। এসব গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ঠাকুর মান্দায় শিব নদের দুই পাড়ের তীর উপচে ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ১০০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। বন্যায় কুসুম্বা-ঠাকুরমান্দা সড়ক দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এদিকে আত্রাইয়ে গত তিন দিনের অবিরাম বর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে আত্রাই নদের পানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় গত চার দিনের টানা হালকা ও ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বন্যা দেখা দিয়েছে। চারটি নদের পানি উপচে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ির। তলিয়ে গেছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টরের আমন খেত। ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ। বদরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র উত্তম কুমার সাহা বলেন, পৌরসভার ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহস্রাধিক পানিবন্দী মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পরিবারপ্রতি ৫ কেজি চাল ও দেড় কেজি করে ডাল বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা কনক চন্দ্র রায় বলেন, ৯ হাজার ৮৮০ হেক্টরের আমন খেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বাংটুর ঘাট এলাকার তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকায় বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে লোকজন l প্রথম আলো
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বাংটুর ঘাট এলাকার তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকায় বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে লোকজন l প্রথম আলো

ঠাকুরগাঁও পাউবো সূত্রে জানা গেছে, শনিবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত টাঙ্গন নদের পানি ১০ সেন্টিমিটার কমেছে। গতকাল ১০টি পাড়া, মহল্লা ও গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অনেক এলাকা থেকে পানি নামছে। এসব এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, গতকাল সকালের পর বৃষ্টি না হওয়ায় পানি তিন হাত কমে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক কে এম মাউদুদুল ইসলাম বলেন, ৩ দিনে জেলায় ৪২৫ মিলি বৃষ্টিপাত হয়। এতে ৩৬ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান ও ৫৭০ হেক্টর জমির সবজি নিমজ্জিত রয়েছে।

পীরগঞ্জের বৈরচুনা ইউনিয়নের সিরাইল, কাটাবাড়ি, ডাঙ্গাপাড়া, বিদ্ধই, গুচ্ছগ্রাম, নওডাঙ্গা গুড়িপাড়া, ইন্দ্রইল ও খেকিডাঙ্গী গ্রামের ২০০ বাড়ি বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। সাগুনী দ্বিতীয় সেতুর দুপাশের এপ্রোচ সড়ক ভেঙে যাওয়ায় শনিবার পীরগঞ্জ-বোচাগঞ্জ-দিনাজপুর সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। খনগাঁও টাঙ্গন সেতুর পূর্ব প্রান্তে প্রায় দেড় শ মিটার রাস্তা ডুবে গেছে। এতে খনগাঁও সেতু দিয়ে পীরগঞ্জের ঘিডোব, খনগাঁওসহ ১৩টি গ্রামের মানুষের হাবিবপুর, দানারহাট, বেগুনবাড়ি হয়ে জেলা শহরে যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল আওয়াল বলেন, জেলায় ৬৫টি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ভবনে ১২ হাজার দুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার দুই শতাধিক গ্রাম পুনরায় বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। চৌহালীর খাসকাউলিয়া, এনায়েতপুর এলাকার বামনগ্রাম এলাকায় নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে।

পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ভারী বর্ষণের পাশাপাশি উজান থেকে নেমে আসা নদ-নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ করতে শনিবার সন্ধ্যায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মণ্ডলের সভাপতিত্বে সভায় আশ্রয়কেন্দ্রের আশ্রিতদের তিন বেলা শুকনা খাবারসহ খিচুড়ি বিতরণের সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সাংসদ নাজমুল হক প্রধানসহ সব উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

রাজশাহীর বাগমারার বীরকয়ায় গ্রামের পাউবোর বাঁধ ভেঙে বাসুপাড়া ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের নিমাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বাসুপাড়ার সাবেক ইউপির চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বলেন, গতকাল সকালে বীরকয়া গ্রামে পাউবোর বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাঁধ ভেঙে পানি ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। এতে পানি বাসুপাড়া ইউনিয়নের সাঁইপাড়া, কুতুবপুর, হলুদঘর, খয়রা, মন্দিয়াল, ইসলামবাড়ীসহ ১০টি গ্রামে প্রবেশ করে। এতে পানবরজ, আমন, সবজিসহ ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। আটটি পুকুর ও একটি বিলের মাছও ভেসে গেছে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন লালমনিরহাট, নীলফামারী, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও ও পীরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পঞ্চগড়, বদরগঞ্জ (রংপুর), আদমদীঘি (বগুড়া), বাগমারা (রাজশাহী) প্রতিনিধি)