গানের ভেলায় জীবনের ভার

গান গেয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করছেন দুই ভাই হুমায়ুন ও রুবেল। গত বৃহস্পতিবার তোলা ছবি l প্রথম আলো
গান গেয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করছেন দুই ভাই হুমায়ুন ও রুবেল। গত বৃহস্পতিবার তোলা ছবি l প্রথম আলো

রাজধানীর শাহবাগে শিশুপার্কের পাশে দুজন মানুষকে ঘিরে ছোটখাটো জটলা। গান গাইছেন ওই দুজন। গান গাইতে গাইতে একজন বাজাচ্ছেন মন্দিরা, আরেকজন ঢোল। গান শুনে লোকজন তাঁদের টাকা দিচ্ছেন।

ওই দুজন প্রথমে গাইলেন ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। একে একে গাইলেন আরও তিনটি গান। তাঁদের গানের সঙ্গে তালি দিচ্ছিলেন শিহাব নামের একজন। তিনি ও তাঁর অপর দুই বন্ধু মিলে দুই ভাইকে দিলেন ১৫ টাকা। শিহাব বললেন, ‘গানগুলো শুনে ভালো লেগেছে। তাই টাকা দিয়েছি।’

একপর্যায়ে গান থামে। কথা বলার সুযোগ হয় ওই দুই গায়কের সঙ্গে। জানা গেল, তাঁরা দুই ভাই। নাম মো. হুমায়ুন কবির ও মো. রুবেল। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় এভাবে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা।

গত বৃহস্পতিবার কথা হয় হুমায়ুন ও রুবেলের সঙ্গে। নিজেদের সঠিক বয়স জানাতে পারেননি তাঁরা। হুমায়ুন জানালেন, তাঁর বয়স ৩০ হতে পারে। আর রুবেলের ২৭-২৮। বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হুমায়ুন চতুর্থ, রুবেল পঞ্চম। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বাকি ভাইদের মধ্যে দুজন কাজ করেন রংপুরে। একজন থাকেন বাড়িতে। ভাইবোনদের কারও পড়াশোনা তেমন এগোয়নি। রুবেল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আর হুমায়ুন পড়াশোনা করেননি। পাঁচ বছর বয়স থেকে চোখে দেখেন না হুমায়ুন।

দুই গায়কের মা থাকেন দাউদকান্দির রায়পুরের বাড়িতে। বাবা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। মারা গেছেন প্রায় ১৭ বছর আগে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বাবা মারা যাওয়ার পর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

দুই ভাই জানালেন, কখনো হেঁটে, কখনো গাড়িতে করে রাজধানীর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যান তাঁরা। লোকের জটলা দেখলে গান গাওয়া শুরু করেন। অনেক সময় লোকজন না থাকলেও গান শুরু করেন। গান শুনে লোকজন জড়ো হন তাঁদের চারপাশে।

হুমায়ুন বলেন, গান শুনে লোকজন টাকা দেন। প্রতিদিন পান ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। এই দিয়ে তাঁদের জীবন চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মানুষ এখন সাধারণত পাঁচ টাকার কম দেন না।

ঢাকার মুগদার মান্ডায় ভাড়াঘরে থাকেন দুই ভাই। বড় ভাই হুমায়ুন বিয়ে করেছেন। তাঁর তিন বছর ও এক বছর বয়সী দুই সন্তান আছে। গান গেয়ে যা পান তা দিয়ে পরিবারের খরচ চালান। বাড়িতে মায়ের জন্যও কিছু টাকা পাঠান।

রুবেল বলেন, দাউদকান্দিতে ওস্তাদ বাবুল সরকারের কাছ থেকে চার-পাঁচ বছর গানের তালিম নিয়েছেন। কয়েক দিন সারগামও শিখেছেন। তবে বেশি দূর এগোতে পারেননি। তিনি বলেন, গান শুনে শুনে তাঁরা মুখস্থ করেন, পরে বিভিন্ন জায়গায় গেয়ে শোনান।

দুই ভাই জানালেন, ১০-১১ বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। বাড়ি থাকার সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে পেতেন ১ হাজার ২০০ থেকে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকায় কোনো অনুষ্ঠানে গাইলে পান ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।

প্রতিদিন সকাল আটটায় বাসা থেকে বের হন দুই ভাই। আর গান গেয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যাও হয়ে যায়।

দুই ভাইয়ের বড় ইচ্ছা টিভিতে গান গাইবেন। এর আগে অনেকবার চেষ্টাও করেছেন। তবে সুযোগ হয়নি। এর বাইরে হুমায়ুনের আকাঙ্ক্ষা অল্পই। জায়গায় জায়গায় না ঘুরে নির্দিষ্ট একটি ভালো জায়গায় গান গাইতে চান। আর ছেলেমেয়ে দুজনকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করার ইচ্ছা লালন করছেন মনে।

এই রোদ তো এই বৃষ্টি। এর মধ্যে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতে যাওয়া কষ্টের। তারপরও জীবিকার তাগিদে কষ্ট সয়ে যাচ্ছেন দুই ভাই। পথচলতি মানুষকে দিচ্ছেন খানিকটা বিনোদন।